বিদেশফেরত ফুটবলারের হাত ধরে নতুন আশার আলো, কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতায় শঙ্কাও রয়ে যাচ্ছে
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের বিষন্নতা কাজ করে আসছিল, যেন এক দুঃখ ভারাক্রান্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলছে। নব্বই দশক কিংবা ২০০০-এর দশকের শুরুতে যে সোনালি সময় ছিল, তার স্মৃতি রোমন্থন যেন এক প্রবীণ ব্যক্তির যৌবনের প্রশংসায় ডুবে থাকা, যিনি আজ বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে নাম উঠে আসত মনেম মুন্না, কাজী সালাহউদ্দিন, আমিনুল হক, কায়সার হামিদের মতো কিংবদন্তিদের—যাদের মতো খেলোয়াড় আর তৈরি হয় না বলে হতাশা ঝরে পড়ত কণ্ঠে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। বাংলাদেশ ফুটবল প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে এখন যেভাবে দর্শক ভিড় করছেন, তা কয়েক বছর আগেও কল্পনাতীত ছিল। জাতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট ম্যাচ থেকেও ফুটবল মাঠে দর্শকসংখ্যা এখন বেশি। এই উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন এক ব্যক্তি—ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপে শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে লোনে খেলা, লেস্টার সিটির মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরী।
নতুন অধ্যায়ের সূচনা: হামজার আগমন
২০২৫ সালের ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে ০-০ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রথমবার মাঠে নামেন হামজা। নিজের পারফরম্যান্সে পুরো ম্যাচে আধিপত্য দেখিয়ে প্রমাণ করে দেন, স্বপ্নও বাস্তব হতে পারে। তার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে জাতীয় দলের হয়ে খেলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আরও অনেকে।
কানাডার জার্সিতে দুই ম্যাচ খেলা শামিত সোম এখন বাংলাদেশের হয়ে খেলতে প্রস্তুত। ইংল্যান্ডের সান্ডারল্যান্ডের যুব ফুটবলার কিউবা মিচেলও জাতীয় দলে খেলার দ্বারপ্রান্তে। ইতালিতে বেড়ে ওঠা ফাহামেদুল ইসলাম বয়স কম হওয়ায় অভিষেক পাননি, কিন্তু জাতীয় দলের পরিকল্পনায় রয়েছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে খেলা সুলিভান পরিবারের ছোট দুই ভাই— রোনান ও ক্যাভান— বাংলাদেশের হয়ে খেলার উপযোগী।
স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—শুধু বিদেশি রঙ দিয়ে পুরোনো ইঞ্জিন কি সচল রাখা যাবে? বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য অমিত হাসান মনে করেন, “স্বল্পমেয়াদে এটা কার্যকর হলেও, দীর্ঘমেয়াদে সফলতা নির্ভর করবে স্থানীয় কাঠামোর উন্নয়নের ওপর।”
এই বিদেশফেরতদের নিয়ে ঘরোয়া ফুটবলারদের মনোভাব কেমন? ফর্টিস এফসির তরুণ খেলোয়াড় পিয়াশ আহমেদ নোভা বলেন, “ওরা উন্নত লিগে খেলে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যা আমাদের শেখার সুযোগ এনে দেবে। ঘরোয়া ফুটবলের মানও বাড়বে।”
নতুন জাতীয় দলে ডাক পাওয়া পুলিশ এফসির আল-আমিন বলেন, “ওদের সঙ্গে খেলতে পারলে শক্তিশালী হবো, বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নও বাস্তব হতে পারে। আমি হামজা ভাই, শামিত ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে চাই। আরও ভালো খেলোয়াড় আনুক ফেডারেশন।”
তবে আল-আমিন মনে করেন, “দেশি খেলোয়াড়দের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের পারফরম্যান্স উন্নত করতে হবে, তাহলে জায়গা ধরে রাখা যাবে।”
ভবিষ্যতের রূপরেখা
‘সেভ বাংলাদেশ ফুটবল’ কেন্দ্রীয় সদস্য আওসাফ তাসিন বলেন, “ইন্দোনেশিয়াকে দেখলেই বোঝা যায় বিদেশি খেলোয়াড় এনে কি পরিবর্তন আনা যায়। যাদের সাথে একসময় আমরা টক্কর দিতাম তারা এখন অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরবের মতো এশিয়ান জায়ান্টদের সাথে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও সে পথেই আছি, সব ঠিকঠাক ভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ বিশ্বকাপে খেলা অসম্ভব নয়।”
‘বাংলাদেশী ফুটবল আল্ট্রাস’-এর কেন্দ্রীয় সদস্য সাইয়েদ ইবনে নাসির বলেন, “বিদেশফেরতদের আনার পাশাপাশি ঘরোয়া কাঠামো ও বয়সভিত্তিক ফুটবলেও জোর দিতে হবে, না হলে প্রকল্পটি ব্যর্থ হতে পারে।”
বাংলাদেশের ফুটবল এক সময় ছিল জাতির প্রিয়তম সম্পদ। সেই চেতনাকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে হলে ১৭ কোটির বেশি মানুষের সম্ভাবনায় বিনিয়োগ করতে হবে—ঘরোয়া কাঠামোতে, তরুণ প্রতিভায়, এবং এক বাস্তবভিত্তিক, টেকসই পরিকল্পনায়।