২০২৪ সালের ৫ জুন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায় ঘোষণার পরপরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে এ আন্দোলন দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরিপত্র পুনর্বহালসহ আরও কয়েকটি দাবিতে তিন দিনের টানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী অবস্থান নেন। সেখান থেকে মিছিল বের হয়ে কলাভবন, শেড, মল চত্বর, মাস্টারদা সূর্য সেন হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও বসুনিয়া তোরণ হয়ে আবার টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে ফিরে আসে। পরে সেখানে সমাবেশ হয়।
৪ জুলাই পর্যন্ত সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘৪ জুলাইয়ের মধ্যে আইনিভাবে আমাদের দাবির চূড়ান্ত সুরাহা করতে হবে। আমাদের আশ্বস্ত করতে হবে, যাতে কোটাব্যবস্থার স্থায়ী ফয়সালা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে গ্রন্থাগার খোলা রাখতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের হলসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো হল বন্ধ করা যাবে না, গ্রন্থাগারও বন্ধ করা যাবে না। প্রত্যয় স্কিমের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের দাবির প্রতি আমরা একাত্মতা প্রকাশ করি। তবে আমাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো যেন বন্ধ না হয়।’
সমাবেশে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম। পরদিন মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে গণপদযাত্রা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদেরও একই সময়ে একই কর্মসূচিতে অংশ নিতে আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া ৩ ও ৪ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের কথা জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সারজিস আলম বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মনে করি। তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হোক। কিন্তু কোটাবৈষম্য দূর হওয়া প্রয়োজন। বৈষম্য আমরা মেনে নিতে পারি না।’
বেলা ১ টায় সমাবেশ শেষ হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বাকের মজুমদার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেরুন নেসা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা আরও কিছু দাবি উত্থাপন করেন, যার মধ্যে রয়েছে- পরবর্তী সময়ে সরকার কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিলে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহালের ভিত্তিতে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করা, সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনা করা, চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার বন্ধ করা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলো মেধার ভিত্তিতে পূরণ করা এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করা।
২০২৪ সালের ৫ জুন পবিত্র ঈদুল আজহার আগে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন উচ্চ আদালত। ওই দিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে, যা শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ৪ জুলাই তারিখ নির্ধারণ করে।
ঈদের ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁকা হয়ে গেলে আন্দোলনকারীরা দাবি বাস্তবায়নের জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা দিয়ে আন্দোলনে সাময়িক বিরতি নেন।
২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা চালু ছিল, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ অনগ্রসর জেলার কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা ছিল। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়।
আন্দোলনকারীরা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি তোলেন। পরে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি করে, যা কার্যত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৬ বছর ধরে চালু থাকা কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়।
পরে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ওই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটার অংশটি চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন, যার রায়ে ২০২৪ সালের ৫ জুন সেই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়।