বাংলাদেশের আলোড়নপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনাপ্রধানরা মাঝেমধ্যেই ব্যারাকের গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছেন। কখনো গণতন্ত্রের রক্ষক, আবার কখনো তা বিপর্যস্তকারী। সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বহুবার জাতীয় সংকটের কেন্দ্রে থেকে রাষ্ট্রশক্তির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তাদের কিছু সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক গতিপথই বদলে দিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
জেনারেল ওয়াকার বাংলাদেশের ১৮তম সেনাপ্রধান।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর কে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন—তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দেয়।

মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী তখন রাজনীতিতে ফিরে যাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে জিয়াউর রহমানকে অনেকে সেনাপ্রধানের জন্য স্বাভাবিক পছন্দ ভাবলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেএম শফিউল্লাহকে নিয়োগ দেন।
যদিও শফিউল্লাহ নিজে জিয়ার সিনিয়রিটি ও যোগ্যতা স্বীকার করেছিলেন, তবু শেখ মুজিব সামরিক পদের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকেই গুরুত্ব দেন। সেনা নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ভবিষ্যতের দ্বন্দ্বের বীজ বপন করে।
শফিউল্লাহর নেতৃত্বকালও এক ট্র্যাজেডিতে গড়ায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনা কর্মকর্তা শেখ মুজিব ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে। সেনাপ্রধান হয়েও শফিউল্লাহ সে হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থ হন।
এর দশ দিন পর সেনাপ্রধান হন জিয়াউর রহমান। নভেম্বরের ৭ তারিখে সংঘটিত একটি বিশৃঙ্খল বিদ্রোহ-গণআন্দোলনের ঢেউয়ে তিনি দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
পরে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হলেও এই বিভাজন মেটাতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তিনি পাকিস্তানফেরত এইচএম এরশাদকে সেনাপ্রধান বানান, যা অনেক মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়।

১৯৮১ সালে সেনা কর্মকর্তাদের হাতে জিয়া নিহত হলে এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।
তার পতন সম্ভব হয়েছিল প্রধানত তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নূরউদ্দিন খানের কারণে। তিনি বিক্ষোভরত সাধারণ নাগরিকদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানান।
এই পদক্ষেপ তাকে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা এনে দেয়।
জেনারেল নূরউদ্দিনকে এরশাদ এতটাই অপছন্দ করতেন যে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তিনি দুর্ঘটনার কবলে পড়া খানকে ‘খোঁড়া’ হিসেবে উল্লেখ করতেন। তবে গণতান্ত্রিক উত্তরণে ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে জেনারেল নূরউদ্দিন শ্রদ্ধার এক নাম।

১৯৯৬ সালে ফের সেনাবাহিনীতে ভেতরকার বিরোধ সামনে আসে।
তখন জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে দুই সিনিয়র কর্মকর্তা—মেজর জেনারেল জি এইচ মুর্শেদ খান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুর রহমান— কিছু সমালোচনামুখর বক্তব্য রাখেন।
রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস সেনাপ্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমকে ব্যবস্থা নিতে বলেন, কিন্তু নাসিম তা না করে অনুগত বাহিনীকে ঢাকার দিকে রওনা হতে বলেন।
সাভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ছাউনিগুলো বিশ্বাসের পক্ষে থাকায় নাসিম ব্যর্থ হন এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ব্যর্থ বিদ্রোহ, যদিও উদ্বেগজনক ছিল, সেনাবাহিনীর একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলে—যেখানে বাহিনী একক কারো অনুসারী নয়।

এরপর ২০০৭ সালে জেনারেল মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ফের রাজনৈতিক পরিসরে প্রবেশ করে।
নির্বাচনপূর্ব বিশৃঙ্খলার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে বাধ্য করা হয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে। গঠিত হয় এক টেকনোক্র্যাটিক সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদ।
পরে উইকিলিকস জানায়, এসব উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সক্রিয় পর্যবেক্ষণ ও আংশিক উৎসাহ ছিল।
মইনের শাসনামলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, প্রশাসনিক সংস্কারসহ সেনাবাহিনীর প্রভাব বেড়ে যায়। শুরুতে জনপ্রিয়তা পেলেও পরবর্তীতে সমালোচিত হয় বেসামরিক কর্তৃত্বকে দুর্বল করার জন্য।

কয়েকজন সেনা প্রধানের পর জেনারেল আজিজ আহমেদ ২০১৮ থেকে ২০২১ সেনা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। পাঁচজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তার নিয়োগ বিতর্ক সৃষ্টি করে।
তার মেয়াদে আন্তর্জাতিক মিশন ও সামরিক চুক্তি বাড়লেও ২০১৮ সালের “রাতের ভোট”-এর নির্বাচন তার সময়ের বিতর্কিত এক অধ্যায়। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে সরকার ও সেনাবাহিনী দুটোই বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
আজিজ, যাকে এই প্রক্রিয়ার অন্যতম রূপকার বলা হয়, বিদায়ের সময় জনমনে অনাস্থার ছাপ রেখে যান।
এরপর সেনাপ্রধান হন এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং ২০২৪ সালের জুনে দায়িত্ব নেন ওয়াকার-উজ-জামান। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জাতীয় সংকটের মুখে পড়েন তিনি।
ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ এবং সরকারের দমন-পীড়নের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হন। আন্দোলন দমাতে এর আগেই তার বাহিনীগুলোর গুলিতে মৃতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়।

ওয়াকারের সেনাবাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়, ফলে দেশ গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচে। এই মানবিক সিদ্ধান্ত ওয়াকারকে জনবান্ধব সেনানেতার মর্যাদা দেয়।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ওয়াকার জানান, সেনাবাহিনী ছাত্রনেতা ও বেসামরিকদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করবে।
এরপর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন—এই অনুষ্ঠান তদারকি করেন জেনারেল ওয়াকার, যা সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকাকে তুলে ধরে।
এই পদক্ষেপ শুধু গৃহযুদ্ধ রোধ করে না, বরং সেনাবাহিনীকে ‘রাজনীতির রূপকার’ থেকে ‘পরিবর্তনের রক্ষক’-এ পরিণত করে।

ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদকে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দিয়ে ওয়াকার নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দেন এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানান যে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।
তার সময়োচিত ও পরিমিত অবস্থান দেশে-বিদেশে প্রশংসা পেলেও, অনেকে সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধানদের ইতিহাস মূলত ক্ষমতা, প্রতিবাদ ও কখনো-কখনো উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক উপাখ্যান। কেউ সংবিধান রক্ষা করেছেন, কেউ তা পুনর্লিখন করেছেন। কিন্তু ওয়াকারের বিচক্ষণ নেতৃত্ব অতীতের চক্র ভাঙার সুযোগ তৈরি করেছে।
তিনি ইতিহাসের পাতায় রক্ষক নাকি ছায়াশাসক হিসেবে থাকবেন তা ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করছে।
তবে অনেকেই বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬-এর মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে প্রতিশ্রুতি কতটা রাখবে তার ওপরও ওয়াকারের ভূমিকা নির্ধারিত হবে।