প্রায় তিন দশক আগের ঘটনা।
১৯৯৬ সালের মে মাস। মাত্র কিছুদিন আগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই সরকার ১২ জুন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সর্বদলীয় নির্বাচনের আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত।
১৫ ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক বিতর্কের পর ষষ্ঠ সংসদে তড়িঘড়ি করে পাশ হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল। এতে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির অধীনস্থ করা হয়। সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিএনপি-সমর্থিত আব্দুর রহমান বিশ্বাস, যিনি একইসঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মেয়াদ শেষ হওয়ার দু’বছর আগে নিয়োগ পাওয়া সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম তখনও দায়িত্বে রয়েছেন।

নির্বাচনকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সেনাপ্রধানের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। সেনাপ্রধানের ঘনিষ্ঠ দুই কর্মকর্তা—বগুড়ার জিওসি মেজর জেনারেল জি.এইচ. মুরশেদ খান এবং বিএমএ’র কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিরন হামিদুর রহমান—রাষ্ট্রপতির বিরোধিতায় প্রকাশ্যে অবস্থান নেন। বিষয়টি সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।
মে মাসে যখন সারা দেশে নির্বাচনী উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন সেনাবাহিনীর ভেতরেই শুরু হয় ছায়াযুদ্ধ। গোপনে এগিয়ে চলে এক সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের ছক, যা বাস্তবায়িত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।
১৮ মে রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস দুই কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানোর আদেশ দেন। সেনা সদর এই আদেশ বাতিলের অনুরোধ করলেও রাষ্ট্রপতি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
পরদিন সেনা সদর ও বঙ্গভবনের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছে।
দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্তে রাষ্ট্রপতির আদেশের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সেনাপ্রধান নাসিম সেনা ইউনিটগুলোকে ঢাকার পথে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। বগুড়া, যশোর ও ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনারা রওনা হয় রাজধানীর দিকে—যা কার্যত ছিল ‘মার্চ অন ঢাকা’।
১৯ মে ভোরবেলা রাজধানী ঢাকা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, সেনাবাহিনী বঙ্গভবন ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দখল করতে যাচ্ছে।
কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তোলেন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান।

সাভার ও গাজীপুরের প্রবেশমুখে তিনি ব্যারিকেড বসিয়ে সেনা ইউনিটগুলোর ঢাকামুখী যাত্রা প্রতিহত করেন। পরে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টও একইভাবে সেনাপ্রধানের আদেশ অমান্য করে।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেনানিবাসের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়—সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভাজন তৈরি হয়েছে। ঢাকায় তখন যেন যুদ্ধবিহীন এক অবরোধ পরিস্থিতি।
২০ মে সকালেই নাসিমের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তাকে গৃহবন্দি করা হয়। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড।
পরবর্তীতে জিওসি ইমামুজ্জামান বলেন, এই পদক্ষেপ ছিল নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেমের ফল। তার ভাষায়, ‘একজন সেনাপ্রধান ব্যক্তিগত বিরোধে পুরো বাহিনীকে জড়াতে পারেন না।’
২১ মে রাষ্ট্রপতি অনুগত বাহিনী নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং নাসিমসহ সাত কর্মকর্তা আটক হন। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান।
এরপর সেনা তদন্ত আদালত গঠিত হয়। মোট ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়—সাতজনকে বরখাস্ত ও আটজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন—মেজর জেনারেল হেলাল মুরশেদ খান, আইন উদ্দিন, ইব্রাহিম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিরন হামিদুর রহমান ও আজিজুল হক।
নাসিমসহ তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে সেনাবাহিনী দেখিয়ে দেয়, তাদের মূল অংশ সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অনুগত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১২ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েকজনকে নির্দোষ ঘোষণা করে।
অক্টোবরে জেনারেল নাসিম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চাকরিতে পুনর্বহালের আবেদন করেন এবং দাবি করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা বেগম জিয়া তাকে নির্বাচনে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তবে সে দাবি নাকচ করেন তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল এমএ মতিন। তিনি বলেন, নাসিমের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ছিল ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ থেকে উদ্ভূত এবং খালেদা জিয়া কখনও তাকে এমন আহ্বান করেননি।
জেনারেল নাসিমের পক্ষে দাবি ছিল—তিনি শুধু বাহিনীর চেইন অব কমান্ড রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। আর রাষ্ট্রপতির পক্ষে অভিযোগ ছিল—নাসিম ক্ষমতা দখলের জন্য পরিকল্পিতভাবে সেনা মোতায়েন করেন।
ডিজিএফআই প্রধান মতিন আরও অভিযোগ করেন, নাসিম ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে এক কনফারেন্সে ক্ষমতা দখলের বিষয়ে ফোর্স কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
তবে লে. জেনারেল নাসিম তার আত্মজীবনীতে পাল্টা দাবি করেন—মতিন নিজেই বলেছিলেন, ‘দেশের দায়িত্ব নিতে হতে পারে।’ জবাবে নাসিম বলেছিলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদ নই, জনগণ আমাদেরকে ক্ষমতা দেয়নি।’
শেষ পর্যন্ত নাসিম এই ঘটনাকে রাষ্ট্রপতির চেইন অব কমান্ড ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেন। তার ভাষায়, রাষ্ট্রপতি চেয়েছিলেন জরুরি অবস্থা জারি করে ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করতে।
ঢাকায় বাহিনী আনতে বাধ্য হওয়া প্রসঙ্গে নাসিম লিখেন, রাষ্ট্রপতির বেআইনি হস্তক্ষেপ ও কিছু কর্মকর্তার বিদ্রোহমূলক আচরণ রোধে তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
সেনাবাহিনীর বড় অংশই অবশ্য তার দাবিকে ঠিক মনে করে না।