মাত্র ১২ দিন স্থায়ী হয়েছিল ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক যুদ্ধ। এই স্বল্পকালীন কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাতের নাটকীয় পরিণতি ঘটে ২৩ জুন, যখন ইরান কাতারের মার্কিন বিমানঘাঁটি আল-উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এমন একটি স্পর্শকাতর আক্রমণ সত্ত্বেও যুদ্ধ আর বিস্তৃত হয়নি। বরং যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে দ্রুত সংঘাতের অবসান ঘটে। প্রশ্ন উঠেছে-কেন এটি আরও বড় সংঘাতের রূপ নেয়নি?
এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের হামলাটি ছিল একটি কৌশলগত ‘সংকেতমূলক’ পদক্ষেপ, যার লক্ষ্য ছিল প্রতিশোধ নয়, বরং বার্তা পৌঁছে দেওয়া। ইরান থেকে ছোড়া ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে কাতার ১৩টি ভূপাতিত করে, এবং একটি নির্জন এলাকায় গিয়ে পড়ে। এতে কোনো প্রাণহানি বা বড় ধ্বংস হয়নি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, হামলার আগে ইরান যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারকে পূর্ব সতর্কতা দিয়েছিল। এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দেয়, ইরান নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে এ হামলাকে প্রতীকী প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হোক, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হিসেবে নয়।
হামলার পরপরই শুরু হয় কূটনৈতিক তৎপরতা। কাতার ও ওমানের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেন। আল-উদেইদ ঘাঁটি থেকে আগেভাগেই মার্কিন সেনা ও বিমান সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যা যুদ্ধ থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও যুদ্ধ বিস্তারের আশঙ্কা ছিল ক্ষতিকর। কাতারে হামলার পরপরই জ্বালানি তেলের বাজারে দাম পড়ে যায় এবং শেয়ারবাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে উভয় পক্ষই উত্তেজনা প্রশমনের পথে হাঁটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল- ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করা। যা আংশিকভাবে অর্জন করেছে, তাই তাদের আর সংঘাত বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল না।
যুদ্ধ থামলেও উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পরমাণু ইস্যুতে নতুন আলোচনার পর্ব শিগগিরই শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সমঝোতার ধারাবাহিকতা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকার ওপর।
সংক্ষেপে বলা যায়, কাতারে ইরানের হামলা যুদ্ধ উসকে না দিয়ে বরং সংযম, কূটনীতি ও কৌশলের মাধ্যমে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত একটি সংঘাতে পরিণত হয়েছে।

কাতারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক কেমন?
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি কাতারের আল-উদেইদে অবস্থিত। কাতার আফগানিস্তানে তালেবান এবং গাজায় হামাস ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিল।
অন্যদিকে, ইরানের সঙ্গেও কাতারের রয়েছে উষ্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। দোহাভিত্তিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ রুদি বারুদি বলেন, ‘সাউথ পার্স, নর্থ পার্স এবং নর্থ ফিল্ড—এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো কাতার ও ইরান যৌথভাবে ব্যবহার করছে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে।’
তার ভাষায়, শুধু সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রেই পৃথিবীর অন্যান্য সব গ্যাসক্ষেত্র মিলিয়ে যত গ্যাস মজুত আছে, তার প্রায় সমান পরিমাণ রয়েছে।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে কাতারের আমিরকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখেন, ‘এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’
অন্যদিকে, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান মঙ্গলবার কাতারের আমিরকে ফোন করে হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি নিশ্চিত করেন, কাতার বা তার জনগণ ইরানের হামলার লক্ষ্য ছিল না।
কাতারের আমিরের দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘ইরান কাতারকে প্রতিবেশী, মুসলিম ও ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং ভবিষ্যতেও সার্বভৌমত্ব ও পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় থাকবে- এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে।’

কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলেন, ‘এই উত্তেজনা প্রশমনে কাতার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে একযোগে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে।’
বিশেষজ্ঞ রুদি বারুদি বলেন, ‘ওয়াশিংটন ও দোহা এক অদৃশ্য অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিস্ফোরণ ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে।’
তার মতে, উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিপুল সংখ্যক তেল ও গ্যাসকূপ, রিফাইনারি, পাওয়ার প্ল্যান্ট ও পানিশোধনাগার- যা যেকোনো বড় সংঘাতে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ত।
তিনি বলেন, ‘পুরো উপকূলজুড়ে ৩৪টির বেশি রিফাইনারি, ১০৫টির বেশি বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ কেন্দ্র রয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় এই অবকাঠামো এখন নিরাপদ। এজন্য কাতারকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া উচিত।’