অভিমানের বরফ বুঝি গলল অবশেষে!

টাইমস স্পোর্টস
6 Min Read
চেনা রুপে ফিরেছে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়াম। ছবি: টাইমস অফ বাংলাদেশ

রবিবার বিকেল ৪টা ৪১ মিনিট। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের এক নম্বর গেট দিয়ে বেরোতেই আটকে যেতে হলো দর্শকদের লম্বা লাইনের সামনে। পাঁচ নম্বর গেটের সামনে থেকে শুরু হওয়া সেই লাইন গিয়ে ঠেকেছিল প্রশিকা মোড় পর্যন্ত। ভ্যাপসা গরম, কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছেন একে একে, তবুও বিরক্তির কোনো ছাপ নেই উল্কি আঁকানো, জাতীয় দলের জার্সি পরে মাথায় লাল-সবুজের ব্যান্ডানা বাঁধা দর্শকদের চেহারায়। তাদের ফুঁৎকারে বেজে ওঠা ভুভুজেলা সদৃশ বাঁশির আওয়াজই বলে দিচ্ছিল, গ্যালারিতে যাওয়ার জন্য ঠিক কতটা উন্মুখ ছিলেন সবাই। 

উপলক্ষ্য একটাই, দীর্ঘ ১৪ মাস পর হোম অফ ক্রিকেটে বাংলাদেশকে আবার টি-টোয়েন্টিতে খেলতে দেখা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল না, বরং ছুটি কাটিয়ে কর্মব্যস্ততায় ফিরেছে নগরী। তবুও মাঠে উপচে পড়া ভিড়। রোদ পশ্চিমের হেলে পড়ার আগেই পূর্ণ হতে থাকে গ্যালারি। শুরুতে থেকে থেকে উল্লাসের আওয়াজ উঠলেও ক্রিকেটারদের অনুশীলন করতে দেখে গলার যেন জোর পান দর্শক-সমর্থকেরা। আর সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে লিটন দাস টস জেতার পর শোনা গেছে সবচেয়ে বড় হর্ষধ্বনি। 

সূর্য ডোবার সাথেসাথেই ফ্লাডলাইটের আলো জ্বলেছে। তাপ কমেছে দিনের, এর সাথে পাকিস্তানের ইনিংসের প্রথম বল থেকেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমর্থকদের গর্জন। প্রথম ওভারে শেখ মাহেদী হাসানের বলে ফাইন লেগে ফখর জামানের ক্যাচ ফেলার পর তাসকিন আহমেদের ওপর দর্শকরা খানিকটা বেজার হলেও পরের ওভারে তার জন্যই গলা ফাটিয়েছেন সবাই। ডিপ ফাইন লেগে রিশাদ হোসেনের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন সাইম আইয়ুব। 

দর্শকে পূর্ণ গ্যান্ড স্ট্যান্ড থেকে শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড। ছবি: টাইমস অফ বাংলাদেশ

তানজিম হাসান সাকিব বোলিংয়ে এসেছেন ইনিংসের পঞ্চম ওভারে। প্রথম বলে পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আলী আগা দুই রান বের করেন কভার পয়েন্টের ওপর দিয়ে। কিন্তু পরের চারটা বলে তানজিম রীতিমতো তাকে নাকানিচুবানি খাইয়েছেন একেকটা গুড লেংথ ডেলিভারিতে। লাইনে পিচ করা বলে ব্যাট ছোঁয়াতেই ভয় পাচ্ছিলেন যেন সালমান। তানজিমের ঐ দাপুটে বোলিং দেখে গ্যালারিতে শুরু হয় ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’ স্লোগান। ওদিকে ডট বলের চাপে পড়ে গেছেন পাকিস্তান অধিনায়ক। ফাইন লেগে সার্কের মধ্যে থাকায় রানের আশায় শেষ বলে খেলতে গেলেন স্কুপ। ব্যাটে-বলে হয়নি ঠিকঠাক, ক্যাচ উঠল লিটন দাসের হাতে। 

এরপর বারবার দর্শকদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন তাসকিন-মোস্তাফিজরা মিলে। ১১০ রানের বেশি তারা করতে দেননি পাকিস্তানকে। ব্যাটিংয়ে শুরুটা ভালো না হলেও দর্শকদের সমর্থনে কোনো কমতি ছিল না। পারভেজ হোসেন ইমন আর তাওহিদ হৃদয় মিলে একটা বড় জুটিতেই ম্যাচ নিয়ে আসেন হাতের মুঠোয়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মূল যে উপাদান, বিনোদন। এটার জন্য দর্শকরা ইমনকে একটা বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই পারেন। পাঁচটা ছক্কা মেরেছেন একাই, আর গ্যালারির গর্জন? সে আন্দাজ করে নিন।

ইমনের ঝড়ো ফিফটি
দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ফিফটির পর পারভেজ ইমনের উদযাপন। ছবি: বিসিবি

অথচ কিছুদিন আগেও ফুটবলের যেখানে গণজোয়ার ছিল, বাংলাদেশের ক্রিকেটের বাজার তখন তলানিতে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট হার, খালি গ্যালারি, টিভি স্বত্ব বিক্রি হচ্ছে না। সব মিলিয়ে মাঠের পারফরম্যান্স ও মাঠের বাইরের নানান ইস্যুতে এলোমেলো ক্রিকেট। দেশের বাইরে গেলেও সমর্থন পান লিটন-তাসকিনরা। আরব আমিরাতেও পেয়েছেন, কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা প্রবাসীরা খেয়েছেন এই সহযোগী সদস্য দেশটির কাছে সিরিজ হারে। এরপর পাকিস্তান হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর, তুমুল শোরগোল ওঠে ক্রিকেট থেকে বাংলাদেশের দর্শক-সমর্থকদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার। 

বাংলাদেশ
মিরপুরে দারুণ এক সন্ধ্যা কাটল বাংলাদেশি পেসারদের। ছবি: বিসিবি

তবে রবিবারের গ্যালারি দেখে তা কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয়? সাম্প্রতিক সাফল্য বলতে শ্রীলংকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ হয়। তবুও গাঁটের পয়সা খরচ করে দর্শকরা মাঠে এসেছেন খেলা দেখতে। প্রিয় দলের ওপর করা অভিমানের পরিমাণ কি কমল? নইলে এই অনাগ্রহের পরেও কেন তারা মাঠে আসেন? 

খেলা দেখতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মঈন হাসান বললেন, ‘ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বাংলাদেশের খেলা দেখতে আসা। ক্রিকেটের সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এটা সত্য। অনেক দর্শক ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, এমন কথাও শোনা যায়। কিন্তু আমার কাছে, আমাদের কাছে ক্রিকেট সবসময়ই আনন্দের অংশ মনে হয়।’

মিরপুরে বেড়ে ওঠা আশনান নাভিদ এখনো হোম অফ ক্রিকেটে ছুটে আসেন আত্মিক টানে, ‘মিরপুরেই বড় হয়েছি আমি, শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের সাথেও তাই আলাদা একটা আত্মিক টান আছে আমার। ২০০৭ সালে প্রথম টেস্ট দেখতে আসি এই মাঠে, আজকেও এলাম টি-টোয়েন্টি দেখতে। সব মিলিয়ে ৫০টার বেশি ম্যাচ দেখেছি এখানে।’

ইস্টার্ন গ্যালারি, পুরোটা সময় মাতিয়ে রেখেছিল মাঠ। ছবি: টাইমস অফ বাংলাদেশ

ইদানিং ক্রিকেটের প্রতি যে অনাগ্রহের কথা বলা হচ্ছিল, এর দায় অনেকটাই মিরপুরে খেলার পরিমাণ কমে যাওয়াতে। অবশ্য মিরপুরে ম্যাচ কমিয়ে দেয়ার পেছনে দেশের অন্যান্য ভেন্যুতে ক্রিকেট উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়ার একটা ভাবনাও ছিল বিসিবির। যদিও ব্যাপারটা সময় সাপেক্ষ। নতুন সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, ক্রিকেট বিকেন্দ্রীকরণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। বাস্তবায়ন হলে মিরপুরের মতো সারাদেশেই ক্রিকেট উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা অনেকের। 

এদিকে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের যেসব হোম সিরিজ হয়েছে, মিরপুর ম্যাচ পেয়েছে কমই। যার অধিকাংশই ছিল টেস্ট। দিনের ৮-৯ ঘণ্টা নিশ্চয়ই টেস্ট দেখার জন্য সব ছেড়েছুড়ে দর্শকরা মাঠে আসবেন না! আর বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিও এত উঁচু নয় ইংল্যান্ডের মতো। কাজেই সেই বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় নেই। তবে সাদা বলের কোনো ম্যাচ হলে সিলেট, চট্টগ্রাম কিংবা মিরপুর; মানুষ দলে দলে ঠিকই ভিড় জমান গ্যালারিতে।

সুপার সানডে’তে তাই ঢাকা কেন্দ্রিক ক্রিকেটের সমর্থকরা আরও একবার প্রমাণ করেছেন, গত দুই যুগ ধরে সমর্থন দিয়ে আসা এই দলটাকে গ্যালারি থেকে উৎসাহ যোগাতে তারা হোম অফ ক্রিকেটে আসবেনই। দীর্ঘদিন ধরে হাসিকান্নার সঙ্গী হয়ে ওঠা এই ক্রিকেটারদের সাথে অভিমানের বরফ জমলেও তা গলবেই…

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *