অন্তত আগামী এক বছর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাতে চায় না বিএনপি। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরামগুলোকে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে বলে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
‘আগেও বিএনপি এমন নীতিতে ছিল, এখনো তাই আছে,’ বলে একজন শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন।
গত বছরের ৮ আগস্ট সরকার গঠনের পর বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং উদ্যোগের সঙ্গে বিএনপি একমত না হলেও সরাসরি তার প্রতিবাদ করেনি। ওইসব বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে বিএনপি তার আপত্তির কথা জানালেও প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। দুয়েকটি বিষয়ে সরকার বিএনপির অবস্থান মেনে নিয়েছে, কিছু বিষয়ে আপত্তির পরও নীরব থেকেছে বিএনপি।
শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠলেও সাংবিধানিক কারণে বিএনপি তার সঙ্গে একমত হয়নি। শেষ পর্যন্ত সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবনে বহাল আছেন।

পাশাপাশি সরকারের সংস্কার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি তাদের প্রস্তাব তুলে ধরেছে। এক্ষেত্রে তারা জরুরি সংস্কারগুলো বর্তমান সরকারের সময় শেষ করে বাকিগুলো নির্বাচিত সরকারের আমলে বাস্তবায়নের পক্ষে।
এখনই এ নিয়ে সরকার-বিএনপির মধ্যে বড় কোনো মতবিরোধ দেখা না গেলেও ভবিষ্যতে সেটা হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
তবে আপাতত সেদিকে পা না বাড়িয়ে সরকারের প্রায় সকল সিদ্ধান্তে প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পক্ষেই বিএনপি।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা না করা, করলে দল হিসেবে পুরোপুরি নিষিদ্ধ নাকি কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা; এসব বিষয়ে সরকারকে তারা হতাশ করেনি। অন্যদের চাওয়ামতো তারা যমুনার সামনে সমাবেশে যোগ না দিলেও সরকারের সিদ্ধান্তে দ্বিমত করেনি।
‘এর মাধ্যমে তারা এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে যে, প্রধান দল হিসেবে তারা শুধু সরকারের সঙ্গেই ‘‘নেগোসিয়েশন’’ করতে চায়। নিজেদের অবস্থান ধরে রেখে অন্যদের সঙ্গে নয়,’ বলে মন্তব্য করেছেন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগকে সরাসরি নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিল না বিএনপি। এক্ষেত্রে তারা বিষয়টি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনরায় এবং বিচারের ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপের পক্ষে ছিল। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে উপদেষ্টা পরিষদ বিচার পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাকেই যথেষ্ট মনে করেছিল তারা।
তবে সর্বশেষ সরকার বিচারের আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি।
পাশাপাশি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনের যে সংশোধন করেছে, সে বিষয়ে বিএনপি মনে করিয়ে দিয়েছে যে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তারাই প্রথমে এ দাবি তুলেছিল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তার হাতে দেওয়া পত্রে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছিলাম। গত ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাৎকালেও তার হাতে দেওয়া পত্রে আমরা পতিত ফ্যাসিবাদী দল ও সেই দলীয় সরকারের সঙ্গে যারাই যুক্ত ছিল তাদের বিচার দ্রুত করে দেশের রাজনীতির ময়দানকে জঞ্জালমুক্ত করার দাবি জানিয়েছি।’

‘আলোচনায় আমরা স্পষ্ট করে বলেছিলাম যে, আইনি প্রক্রিয়াতেই ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব ও উচিত। বিভিন্ন সভা, সমাবেশে ও আলোচনায় আমরা আমাদের এসব দাবি বারবার উত্থাপন করেছি। উল্লেখযোগ্য যে, আমরা প্রশাসনিক আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে বলেই বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের আগ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিল বিএনপি,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা এবং এর আশপাশে বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং একে ঘিরে অস্থিরতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন: আমাদের দাবি মেনে আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে চাপের মুখে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো বিব্রতকর ও অনভিপ্রেত অবস্থায় সরকারকে পড়তে হতো না। ভবিষ্যৎ কার্যক্রম পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে মনে রাখবে বলে আমরা আশা করি।
সেই সতর্কতা আশা করেই বিএনপি প্রকাশ্যে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও বাস্তবে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়সীমা মেনে নিয়েছে। এ সময়ে প্রধান উপদেষ্টাকে কোনো বিষয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ না জানানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করছি। আমরা বিশ্বাস করি প্রধান উপদেষ্টা তার প্রতিশ্রুতি রাখবেন, জনগণের আকাঙ্খার বাস্তবায়ন করবেন।’
দলের একজন উপদেষ্টা বলেন: ড. ইউনূস সংস্কারের যে কথা বলছেন, বিএনপি অনেক আগে থেকেই তা বলে আসছে। কিছু জায়গায় হয়ত দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের আকাঙ্খার সততা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। তবে তাকেও সকল বাস্তবতা বুঝেই এগোতে হবে।
‘ড. ইউনূস যে প্রেক্ষাপটে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, দেশে-বিদেশে তার যে ইমেজ, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত তার ওপর প্রশ্নাতীত যে আস্থা রেখেছে, বিএনপিও সেরকমই মনে করে। তাই প্রয়োজন না হলে তাকে কোনো বিষয়ে বিএনপি চ্যালেঞ্জ জানাতে চায় না,’ মন্তব্য করে বিএনপির ওই উপদেষ্টা টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘তিনি (ইউনূস) নিজেই চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। এ সময়সীমার মধ্যে তিনি সেটা করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই।’
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। নির্বাচন কমিশনকেও এজন্য প্রস্তুতি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
ওই সময়সীমাকে ধরে বিএনপি আপাতত মাঠের রাজনীতি গরম না করে সাংগঠনিক কার্যক্রমকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে সেরকম কর্মসূচিগুলোতে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।

ভার্চুয়ালি ওইসব কর্মসূচিতে বক্তৃতার পাশাপাশি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়েও তিনি সকল দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন লন্ডন থেকে।
কিন্তু সকলের মনেই প্রশ্ন: কবে দেশে ফিরে তিনি সরাসরি দলকে নেতৃত্ব দেবেন?
লন্ডনে তারেক রহমানের একজন সহযোগী টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন: অন্তর্বর্তী সরকার, বিশেষ করে ড. ইউনূসকে নির্ঝঞ্ঝাটে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্যই তিনি এখন দেশে ফিরছেন না। তিনি দেশে থাকলে প্রশাসন থেকে সবকিছু তারেকমুখি হয়ে যেতে পারে। তিনি এটা চান না।
‘তারপরও যে কোনো দিন তারেক রহমানের দেশে ফেরার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শেষে ৬ মে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সরকার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত করবেন কিনা জানতে চাইলে বিএনপির একজন নীতি-নির্ধারক টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন: প্রয়োজনের তিনি দেখা করতে পারেন। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হলে সেখানেও বিএনপিকে নেতৃত্ব দিতে পারেন খালেদা জিয়া।