‘স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো’ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে

5 Min Read

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মকর্তাদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর প্রস্তাব সম্বলিত আইনের খসড়া সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫’ নামে নতুন এই আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই যা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনে পরিণত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

এই আইনের খসড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা কয়েকগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়াটি অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা সরকারি ও বেসরকারি খাতের মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক হবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান যেটি সুপ্রিম কোর্ট কিংবা মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের মতো সাংবিধানিক মর্যাদা পাবে।

মন্ত্রী পদমর্যাদায় গভর্নর স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। যাকে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। আর যিনি জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করবেন।

খসড়া অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদে সরকারি আমলার পরিবর্তে এই খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা থাকবেন। পরিচালক পদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা তালিকা থেকে সরকার নিয়োগ দেবে।

বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২’ এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক এ সংস্থাটি।

স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম একটি বড় সমস্যা হলো, এটি পুরোপুরিভাবে সরকারের বেতন স্কেলে চলে। পৃথিবীর কোন  উন্নত দেশে কিন্তু এভাবে চলে না। পৃথক বেতন স্কেল থাকে। এই স্কেলটা হবে, সরকারি বেতন স্কেলের অনেক উপরে, কিন্তু বেসরকারি খাতের বেতনের নিচে মাঝামাঝি অবস্থানে।’

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর উদাহরণ টেনে বলেন, ‘বেসরকারি খাতের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হয়তো ২০ লাখ টাকা বেতন পায়। সরকারি খাতের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হয়তো ৩ লাখ বা ১ লাখ টাকা বেতন পায়। এটা খুবই অন্যায্য। এভাবে হলে কখনোই গুণগত জনবল পাবো না আমরা।’

‘এ জায়গায় কাজ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারের শৃংখল থেকে বের হতে হবে। স্বাধীন হতে হবে। ক্ষমতায়ন করতে হবে গভর্নরকে। বোর্ড হতে হবে স্বাধীন’- বলেন গভর্নর।

স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করতে গিয়ে আমলাদের পক্ষ থেকে বাধা আসবে কি না- জানতে চাইলে আহসান এইচ মনসুর টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি জানি বাধা আসবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে হবে। আর্থিক খাত ভিন্ন জিনিস। এটা মেনে নিতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমরা সরকারের টাকায় চলি না। বরং সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা দেই প্রতিবছর।’

‘আমাদের টাকায় আমাদের বেতন নিতে সরকার কেন বাধা দেবে’- প্রশ্ন রেখে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই।’

জানা গেছে, এর আগে ২০১০ সালের নভেম্বরে ৩১৬তম পর্ষদ সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো অনুমোদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছিলেন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এরও প্রায় ১৫ বছর আগে থেকেই স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আলোচনা চলমান রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছরেও নানা অজুহাতে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর অনুমোদন দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। এ কারণে প্রতিবছরই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক মেধাবী কর্মকর্তা বিসিএস সহ আকর্ষণীয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীন করার জন্য ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার’ নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এর খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে দেব। এই মাসে হবে কি না জানিনা। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে দেব। আমরা আশা করি সরকার এটিকে সুবিবেচনায় নেবে।

‘ভবিষ্যতে সেন্ট্রাল ব্যাংক যেন সুরক্ষিত থাকে সেই লক্ষ্যেই এই আইনটি করতে যাচ্ছি। পরবর্তি সরকারের দায়িত্ব হবে এটিকে আইনে পরিণত করা’, বলেন আহসান এইচ মনসুর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫-এর খসড়া গত ১৩ আগস্ট এক বিশেষ সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালনা পর্ষদকে অবহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। তবে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের মেয়াদ সহ কিছু ভাষাগত বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. আরিফ হোসেন খান টাইম অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত ১৩ আগস্ট হওয়া বিশেষ পর্ষদ সভায় সদস্যরা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সেই আলোকে আইনের খসড়াটিতে কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন চলছে। এটি নিয়ে পর্ষদে আরো আলোচনা হবে। তাই চূড়ান্ত হতে হয়তো একটু সময় লাগতে পারে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূতে জানা গেছে, আইএমএফের কারিগরি সহায়তা ও ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস সহ একটি বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫-এর খসড়া প্রণীত হচ্ছে। এই খসড়া থেকে জানা গেছে, সরকারের নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তে কেবল জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদে কোন সরকারি কর্তমর্তা থাকবেন না।

গভর্নরের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ হবে যেখানে গভর্নর মনোনিত দুজন ডেপুটি গভর্নর সহ গভর্নরের সরবরাহকৃত তালিকা থেকে সরকারের মনোনিত ৫ জন পরিচালক থাকবেন। পরিচালক হতে হলে অবশ্যই দক্ষতার পাশাপাশি ন্যূনতম ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, হিসাবরক্ষণ, অর্থ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং, বাণিজ্য, শিল্প ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও আইনের মতো ক্ষেত্রে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *