বাংলাদেশে ‘মব সহিংসতা’ বা ‘মব ভায়োলেন্স’ যেন সামাজিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে ‘জনতার বিচার’ বা ‘মব জাস্টিস’ তকমা দিয়ে একাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের আগস্ট থেকে গেল সপ্তাহের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গণপিটুনি কিংবা মবের শিকার হয়ে ২২২ জন নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জনেরও বেশি।
এর মধ্যে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৮ জন মবের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। জুলাই আন্দোলনের পরপর আগস্ট মাসে নিহত হন ২৩ জন। গত ১৩ মাসে কেবল ঢাকাতেই মব সহিংসতায় ৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আসকের গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার পর মবের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। বন্দরনগরীতে গত ১৩ মাসে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩০ জন। অন্যদিকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুরে সবচেয়ে কম মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব বিভাগে গড়ে দুটি করে মবের শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
মব সহিংসতার সবশেষ ঘটনা ঘটেছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে। গত বৃহস্পতিবার ভোরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চুরির অভিযোগে ৩৫ বছর বয়সী এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগের দিন বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের সন্দেহে দুজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার বছর পেরোলেও কেন এখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে, কেন পুলিশসহ অন্য নিরাপত্তা বাহিনী তাদের দায়িত্বে অবহেলা করছে এমন প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব মেলেনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
সরকার গণপিটুনি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ৭ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘আমরা ব্যর্থ হইনি। যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
তবে তিনি স্বীকার করেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেছে এবং তা পুনরুদ্ধারে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
মব সহিংসতাকে ‘হালকা ভাবে’ নেয়ায় একাধিকবার সমালোচনার মুখে পড়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এবারও অনেকটা দায় এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি। সমাজে ধৈর্যের অভাব আছে। তাই সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাই।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলমও মব সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মত দিতে নারাজ। একসময় তিনি গণপিটুনিতে জড়িতদের ‘চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী’ বা ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তবে গত বৃহস্পতিবার তিনি দাবি করেন, ইদানীং অনেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদকেই ‘গণপিটুনি’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রেসসচিব বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে—কোনটা প্রতিবাদ আর কোনটা গণপিটুনি।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশের দুর্বলতা, আইনি জটিলতা, আইন প্রয়োগে প্রশাসনের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার মতো বিষয়গুলো মব সহিংসতা বৃদ্ধির মূল কারণ।
এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল কায়ূম বলেন, ‘সরকারের দিকনির্দেশনার অভাব, পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়া এবং জনগণের সহযোগিতার ঘাটতি—এই তিনটি হলো গণপিটুনি বৃদ্ধির প্রধান কারণ। সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও তার কার্যত বাস্তবায়ন না থাকায় কেউ আর আইনের প্রতি আস্থা রাখতে চাচ্ছে না।’
এ ধরনের সহিংসতা রোধে দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তিনি বলেন, ‘মবের মনোভাব কেবল জনগণকে উত্তেজিতই করে না, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বাড়ায়। সরকার যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে দেশের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র ধ্বংস হবে।’
একই সুরে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তৌহিদুল হকও। তার ভাষায়, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত, মব সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু সরকার কেবল বিবৃতি দিয়েই দায় শেষ করছে। এই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে উদ্দেশ্যজনকভাবে মব সৃষ্টিকারীরা।’