’২৪ পরবর্তী ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের আস্থা টানতে নানা পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতির আলাপে সরগরম টিএসসি থেকে আবাসিক হল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ক্যাফেটেরিয়া। নির্বাচন কে ঘিরে প্রতিটি প্যানেলই তুলে ধরতে চাচ্ছে নিজেদের দর্শন। কোথাও শোনা যাচ্ছে দলীয় প্রভাবমুক্ত একাডেমিক পরিবেশের প্রতিশ্রুতি, কোথাও আবার সাংগঠনিক শক্তির বড়াই। তবে, এই ভোটের মাঠে প্রধান পাঁচটি প্যানেলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে তৈরি হয়েছে ডাকসুর এক জটিল সমীকরণ। এই হিসাব মেলাতেই প্যানেল গুলোর সাথে আলোচনায় পাওয়া যায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
প্রচলিত রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর সরব উপস্থিতির মাঝেই ব্যতিক্রমী প্রয়াস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের অঙ্গীকার হিসেবে উঠে আসছে শিক্ষার্থীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। প্রধান লক্ষ্য হিসেবে একটি সুষ্ঠু, পক্ষপাতমুক্ত একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাজনীতি দলীয়করণমুক্ত ক্যাম্পাসের কথা তারা বলছেন। এছাড়াও, প্যানেলে ৬ জন নারী এবং ২ জন আদিবাসী শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্তি তুলে ধরছে বহুমুখী নেতৃত্বের প্রতিফলন।
এই প্যানেল থেকে ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে মনোনীত রাফিজ খান, টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘যারা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয় এবং বিভিন্ন দক্ষতার মাধ্যমে অবদান রাখতে চান, আমরা তাদের জন্য ও সুযোগ তৈরি করতে চাই। ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা জানার চেষ্টা চলছে।’

সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘মাদার পার্টির স্পন্সরড কনটেন্টের’ বদলে তারা ভরসা করছেন প্রকৃত ও জৈবিক সংযোগে। রাফিজের ভাষায়, ‘আমরা নতুন হলেও নিরুৎসাহিত হচ্ছি না। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষার্থীদের কাছে অর্গানিক উপায়েই পৌঁছাতে পারব।’
অন্যদিকে ছাত্রদলের পক্ষে রয়েছে মাঠের রাজনীতির অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা, দায়বদ্ধতা ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাই তাদের প্যানেলের প্রধান শক্তি হিসেবে মনে করাটাই টাই স্বাভাবিক। তবে, প্যানেলে মাত্র একজন নারী ও একজন আদিবাসী প্রার্থীর অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটি শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, জোরপূর্বক ইনক্লুসিভিটি দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কিনা।
ছাত্রদলের প্যানেল থেকে এজিএস পদপ্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ এ বিষয়ে বলেন, ‘জয় লাভে কোনো ব্যাকডোর পলিসিতে আমরা বিশ্বাসী নই।’
মায়েদ আরও আশ্বাস দেন, ক্যাম্পাসে গেস্টরুম, গণরুম বা জোরজবরদস্তির রাজনীতি আর ফিরবে না। ভর্তি কার্যক্রমের উন্নয়ন, আবাসন সংকট নিরসন, শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালুর মতো বিষয়গুলো ইশতেহারে থাকার ইঙ্গিত দেন তিনি।
এছাড়াও জানান পাকিস্তানপন্থী প্যানেলকে রাজনিতির সমীকরণের বাইরে রাখার স্বাচ্ছন্দ্যের কথা।
পাশাপাশি এবারের ডাকসু নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের কাছে আগ্রহের আরেকটি নাম হয়ে উঠেছেন ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল থেকে কার্যকরী সদস্য পদপ্রার্থী দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী তাফসিরুল্লাহ।
প্যানেল বেছে নেওয়ার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন গণরুম ও গেস্টরুমের টর্চার কিংবা ডানপন্থী সংগঠনগুলোর অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তার প্যানেলের বাকি সদস্যদের সম্পৃক্ততার কথা। তিনি মনে করেন, বর্তমান প্রশাসন একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়, সেটির বদলে শিক্ষার্থীদের মতামতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিফলিত করার দাবি তুলতেই তার প্যানেল সোচ্চার।
এছাড়াও, ভোট আদায়ের কৌশল হিসেবে জানান নিজ বক্তব্যের শক্তিতে মাঠে টিকে থাকার প্রত্যাশা ও প্যানেলে সর্বোচ্চ ১২ জন নারী, তিনজন আদিবাসী শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্তির কথা।

অন্যদিকে ‘বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলে প্রতিফলিত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেরণা থেকে উঠে আসা বাগছাসের নেতৃত্ব। ঢাবি ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সেটেলমেন্ট, ছাত্র রাজনীতির ধরন ও শিক্ষক রাজনীতির কাঠামো নিয়ে পরিষ্কার রূপরেখা দিতে চান তারা।
তবে, গত বছর কমিটি গঠনের সময় অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে যে অনাস্থা তৈরি করেছিল তা প্যানেলটির ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের স্বীকার করে বলেন, ‘ঘটনাটি অবশ্যই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং এতে আমাদের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেও পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের সম্মানে আমরা হল কমিটি পর্যন্ত দেইনি।’
প্রচারণায় অনলাইনের চেয়ে ‘ডোর-টু-ডোর বা ওয়ান-টু-ওয়ান’ কনেকশনকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বলেও তিনি জানান। পাশাপাশি অনলাইনে প্যানেলের পাঁচ নারী শিক্ষার্থীর চরিত্র হননের প্রচেষ্টাকে তিনি বড় শঙ্কা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং একে সাইবার অপরাধ আখ্যা দেন।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল নিয়ে বলেন, ‘যে প্যানেল স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করে কিংবা লন্ডনের নেতার নির্দেশে রাজনীতি করে, তাদেরও আমরা পরোয়া করি না।’
প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নজর কাড়ছে ইসলামিক ছাত্র শিবিরের নেতৃত্বাধীন ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলও। শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় দুইজন দৃষ্টিহীন ও একজন আদিবাসী প্রার্থীর মনোনয়নের প্রাপ্তিতে প্রকাশ হয়েছে ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি’ বা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।

এছাড়াও, জুলাই বিপ্লব ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের চেতনা ধারণ করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ডাকসুকে জাতীয় পর্যায়ে অনুসরণ যোগ্য সংসদে পরিণত করার আশা প্রকাশ করেন এই প্যানেল থেকে ভিপি পদে মনোনীত প্রার্থী সাদিক কায়েম।
প্রতিশ্রুতি দেন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে এনে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি একটি প্রাণবন্ত ক্যাম্পাস উপহারের।
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে তাই শিক্ষার্থীদের সামনে যেমন জাগছে নতুন আশা, তেমনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে পুরোনো অভিজ্ঞতা ও বিতর্ক। সব প্যানেল ই নিজেদের মতো করে শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করলেও, শিক্ষার্থীদের জন্য এই নির্বাচন শুধু নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার লড়াই নয়, বরং হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, আস্থার পুনর্গঠন ও নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণের এক বড় মঞ্চ ।