বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রকল্পে কোটি কোটি ইউরোর দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত ‘মি. জি’—এই ছদ্মনামে বহুদিন ধরে গোপন প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিচয় অবশেষে প্রকাশ্য হয়েছে। তিনি মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
নেত্র নিউজের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে ফরাসি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘ওবারথার টেকনোলজিস’-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে ‘জি’ এর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তখন ‘ওবারথার টাইগার আইটি’ নামের একটি বাংলাদেশি কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারত্বে এনআইডি সরবরাহের একটি বড় চুক্তি পেয়েছিল। যদিও এতোদিন তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম প্রকাশ্যে আসেনি। তবে আদালতের নথি, ইমেইল, আর্থিক তথ্য এবং সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে এটি নিশ্চিত, ‘মি. জি’ আসলে তারিক আহমেদ সিদ্দিকই।
বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালেই এই দুর্নীতির ইঙ্গিত পেয়ে তদন্ত শুরু করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, দরপত্রে কারসাজি, অতিরিক্ত দামে চুক্তি এবং জাল ইনভয়েসের মাধ্যমে লাখ লাখ ইউরোর ঘুষ লেনদেন হয়। বিশেষভাবে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিচালিত নির্বাচন কমিশনের একটি প্রকল্প ইউনিটের প্রভাব ব্যবহৃত হয়েছিল পুরো প্রক্রিয়ায়।
বিশ্বব্যাংকের ট্রাইবুনালের মতে, প্রথম চুক্তির বিনিময়ে ‘প্রশিক্ষণ ফি’ নামে সিদ্দিককে ৭.৩ লাখ দেওয়া হয়। এরপর অতিরিক্ত একটি সিকিউরিটি হোলোগ্রাম সংযুক্ত করার নামে আরও ৬.১ মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় ৮৮ কোটি টাকা ঘুষ নির্ধারিত ছিল। ‘ওবারথারের’ অভ্যন্তরীণ ইমেইলে সিদ্দিককে ‘দ্য জেনারেল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যিনি প্রকল্পের সম্প্রসারণে নির্ধারক ভূমিকা পালন করতেন।

যদিও ‘টাইগার আইটি’ এবং ‘ওবারথার’ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে, সিদ্দিকের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং, তখনকার ব্রিটিশ ও ফরাসি কূটনীতিকরা তাকে সামরিক অস্ত্র চুক্তির জন্য গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতেন। জানা গেছে, সিদ্দিকের সঙ্গে রাফাল এবং ইউরোফাইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান কেনাবেচা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল।
এদিকে, সিদ্দিক পরিবারের বিত্ত বৈভব বেড়ে যায়। ২০২৪ সালে তার স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক ২.৭ মিলিয়ন ডলারের ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখিয়ে মাল্টার গোল্ডেন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। তার মেয়ে বুশরা ২০১৮ সালে লন্ডনে ১.৯ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের বাড়ি কিনেছেন। ঢাকায় বারিধারা, গুলশান, বসুন্ধরা ও গ্রামে তাদের নামে একাধিক জমি ও বাড়ি রয়েছে— যার মূল্য ৩৮ কোটি টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত মূল্য বিশ গুণ বেশি হতে পারে বলে ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে।
‘টাইগার আইটি’র প্রধান জিয়াউর রহমান ওবারথার সঙ্গে দরপত্র ফাঁস ও যৌথ যোগাযোগে জড়িত ছিলেন। তিনি একটি ব্রিটিশ কোম্পানি ‘ডেকাটার ইউরোপ’-এর মাধ্যমে হোলোগ্রাম প্রকল্পের ঘুষ লেনদেনে সাহায্য করেন, যার বড় অংশই সিদ্দিকের জন্য নির্ধারিত ছিল।
২০১৬ সালের শুরুর দিকেই ওবারথার হোলোগ্রাম প্রকল্পের জন্য ২.৪ মিলিয়ন ইউরোর বেশি টাকা ছাড় করে। এক পর্যায়ে কোম্পানির একজন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, ‘মি. জি আগাম টাকা পেলে আর পাত্তা দেবেন না।’
বর্তমানে এনআইডি প্রকল্প নিয়ে টেন্ডার কারসাজি ও দুর্নীতির মামলাগুলো বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘মি. জি’ খ্যাত তারিক আহমেদ সিদ্দিক দেশ ছাড়েন।
টাইমস অব বাংলাদেশের একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে তারিক আহমেদ সিদ্দিক বসাবস করছেন দুবাইয়ে। এ পর্যন্ত ওই প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।
নেত্র নিউজ জানায়, বিশ্বব্যাংক, ফরাসি এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কেউই বাংলাদেশ সরকারকে অভিযুক্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তার কূটনৈতিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক প্রভাব হয়তো তাকে বিচার থেকে রক্ষা করে রেখেছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।