স্ত্রীকে ঘুমে রেখে মিছিলে গিয়ে শহীদ হন গার্মেন্টসকর্মী জুয়েল

টাইমস রিপোর্ট
6 Min Read
শহীদ জুয়েল রানা। ছবি : বাসস

স্ত্রীকে ঘুমের মধ্যে রেখে বাইর থেকে দরজা বন্ধ করে ৫ আগস্ট দুপুরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে যান গার্মেন্টসকর্মী মো. জুয়েল রানা। গাজীপুর আনসার একাডেমির সামনে বিজয় মিছিলে অংশ নেন তিনি। এরপর শহীদ হয়ে বাড়ি ফিরেন ২৭ বছরের এ টগবগে যুবক।

মো. জুয়েল রানার জন্ম ১৯৯৭ সালের ৯ জুলাই গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শালমারা ইউনিয়নের শাখাহাতি (বালুয়া) গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনা শেষ না করে অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়েন। তার বাবার নাম মো. মোনতাজ উদ্দিন ব্যাপারী (৫৫)। মা মোছাম্মৎ জমেলা খাতুন (৪২)।

শহীদ জুয়েল রানা একই উপজেলার বারপাইকা গ্রামের মো. শাহজাহান আলী (৪৫) ও মোরশেদা বেগম (৩৫)-এর মেয়ে দুলালি আক্তারকে (২৩) পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন। দুটি মেয়ে সন্তান রয়েছে তার।

শহীদ জুয়েলের বড় মেয়ে জান্তা আক্তার জুঁই (৯) গাজীপুরের একটি হেফজ মাদ্রাসায় আবাসিক থাকে। ছোট মেয়ে জিম আক্তার জিনাত (৬)। জিম তার নানা বাড়িতে নানির কাছে থাকেন। বাবা শহীদ হওয়ায় মেয়ে দুটি এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

শহীদ জুয়েল গাজীপুরের ইন্টারস্টোপ গার্মেন্টসে সুইং অপারেটর পদে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী দুলালি আক্তারও গাজীপুরের ইকো টেক্স গার্মেন্টসে কাজ করতেন। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে জুয়েল গাজীপুরের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।

শহীদ জুয়েল রানার স্ত্রী দুলালি আক্তার বলেন, ‘৫ আগস্ট আমরা সকাল ১১ টার দিকে একসাথে খাবার খাই। তখন আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য তার সাথে কথা হয়। তখন সে বলে আমার মেয়েরা যখন বড় হবে তখন বলবে দেশে যখন আন্দোলন হয়েছিল তখন তোমরা কী করছিলা। আমি রক্ত দিছি আরও রক্ত দিব, একবার আমার রক্ত ঝরছে ত কী হয়েছেঃ এবার আমি শুধু রক্ত নয়, প্রয়োজনে জীবন দিব।

দুলালি বলেন, ‘খাওয়া শেষে আমি ওর মাথায় মলম লাগিয়ে দিই। এরপর একসাথে ঘুমাতে যাই। কিন্তু দুপুর ১২ টার পর আমাকে ঘুমের মধ্যে রেখে বাইর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ও মিছিলে যায়। বিকেল ৩ টার দিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর আসে।’

‘পরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান, জুয়েল মারা গেছেন। এরপর বিকাল ৫ টায় শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল হাসপাতালে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় পাই।’

দুলালি আক্তার বলেন, ১২ বছর ধরে সুখে সংসার করছিলাম। সে আমার সবকিছু জুড়ে ছিল। সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। বিদেশ যাওয়ার পর শুধু আমার কারণে আবার দেশে চলে আসে। সবসময় বাবা-মা, শশুড়-শাশুড়ি সবার খোঁজখবর রাখত। নিয়মিত টাকা পয়সা দিত।’

‘প্রতি বৃহস্পতিবার সে মাংস কিনত। সেই মাংস নিজে রান্না করত। ও খিচুড়ি খুব পছন্দ করত। রান্না করতে ভালোবাসত। বেশিরভাগ সময় সেই রান্না করত। আমরা ছুটি কম পেতাম। তেমন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হত না। কিন্তু সে আমাকে প্রায়ই বাজার করতে বাজারে নিয়ে যেত।’

শহীদ জুয়েলের স্ত্রী বলেন, আমাদের সংসারে সুখের কোনো অভাব ছিল না। স্বামীকে হারিয়ে আমি এখন একা হয়ে গেছি। মেয়েরা আমাকে ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। ছোট মেয়েটা ওর নানির কাছে থাকলেও ওর বাবার জন্য কান্না করে। আমার ত পড়াশোনা নাই। তাই এখনও গার্মেন্টসেই চাকরি করতে হচ্ছে। সরকার যদি আমাকে একটি স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দিত তাহলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’র সাথে নিজ বাড়িতে কথা বলেন শহীদ জুয়েলের মা মোছাম্মৎ জমেলা খাতুন। তিনি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন, ‘সকলের প্রিয়পাত্র আছিল হামার জুয়েল। হামার বাবার বুদ্ধি আছিল সেই। কিন্তু নম্র-ভদ্র ছিল। আমাদের দেখা-শোনা করত। সেই যে ছয় ক্লাস পাস দিয়ে কামাইয়ের জন্য বের হইল আর ফিরিল লাশ হয়ে।’

শহীদ জুয়েলের ও তার স্ত্রী। ছবি: বাসস

শহীদ জুয়েলের বড় জেঠা মোফাজ্জল হোসেন জানান, আমরা একই এলাকায় থাকতাম। ও নিয়মিত মিছিলে যেত। ৪ তারিখ বিকালে চন্দ্রায় মিছিলে গিয়ে মাথা ফেটে বাসায় আসে। সেদিন তার মাথায় ৬ টা সেলাই ছিল। পরদিন ৫ তারিখ শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার খবর পেয়ে হই-হুল্লোড় শুনে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে আবার মিছিলে যায়। আনসার একাডেমির ২ নং গেটের সামনে জুয়েল মিছিলে অংশ নেয়। সেখানেই সে তলপেটে গুলি খায়। ভীড়ের মধ্যে কোন হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছিল না। পরে কোনাবাড়ি-সফিপুর হয়ে তাকে তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।

মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার বার বার রক্ত জোগাড় করতে বলেন। আমরা রক্তের জন্য সবখানে খোঁজ করতে থাকি। কিন্তু রক্ত দেয়ার আগেই ডাক্তার জানায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হামার জুয়েল মারা গেছে।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

শহীদ হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট সকাল ১১ টায় জানাজা শেষে শহীদ জুয়েল রানাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

জুয়েলরা ছিলেন ৩ ভাই-বোন। শহীদ জুয়েল ছিলেন সকলের ছোট। বড় বোন মনজিল বেগম (৩০)। বিয়ে হয়েছে পাশের উপজেলা পলাশবাড়ীতে। মেজো ভাই মো. জসিম (২৯)। জুয়েলের মতো তিনিও গার্মেন্টসে চাকরি করেন। তার এক ছেলে লিমন (১২) ও এক মেয়ে জান্নাতি (১)।

ভাগ্য ফেরাতে কর্মের জন্য লিবিয়াতেও গিয়েছিলেন জুয়েল। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেন নি। মারা যাওয়ার বছর খানেক আাগে ২০২৪ সালে লিবিয়া থেকে দেশে ফেরেন তিনি। ধারদেনা করে তাকে বাড়ি নিয়ে আসে তার পরিবার। বাড়ি আসার পর কিছুদিন গ্রামেই বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাতেন। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত গাজীপুরের ইন্টারস্টোপ গার্মেন্টসে চাকরি করতেন শহীদ জুয়েল।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে শহীদ জুয়েলের স্ত্রীকে ৪ লাখ টাকা আর তার মাকে দেয়া হয় ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী পক্ষ থেকে স্ত্রীকে ও মাকে ১ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি থেকে দেওয়া হয় ১ লাখ টাকা। এছাড়া জেলা পরিষদ থেকে শহীদের মাকে ২ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *