রাখাইনের সাধারণ মানুষের জন্য সহায়তা পৌঁছাতে জাতিসংঘ প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডোর’ ঘিরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে বাহিনীগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সরকারের আগ্রহ ও করিডোরের প্রতি নীতিগত সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতার মাঝেই নীতিগতভাবে এর বিরুদ্ধে একক ও সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। তাদের মতে, এই করিডোর মানবিক উদ্দেশ্যে হলেও ভবিষ্যতে এটি ‘প্রক্সিওয়ার’-এর সূচনার কারণ হতে পারে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের আশঙ্কা যে সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি দেশের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যকে মারাত্মকভাবে নষ্ট করতে পারে।
আন্তঃবাহিনী পর্যায়ের একাধিক বৈঠকে করিডোর ইস্যুতে একমত হয়ে বলা হয়েছে, এর আড়ালে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশেষ বাহিনীগুলোর গোপন তৎপরতা চালানোর আশঙ্কা প্রবল।
ওই সূত্রগুলো জানায়, গত সপ্তাহে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি কমান্ড কনফারেন্সেও করিডোরকে সরাসরি ‘প্রক্সিওয়ার’ হিসেবে আখ্যা দেন কয়েকজন জিওসি।
করিডোর ঘিরে ভারত, চীন ও পশ্চিমা শক্তির ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সীমান্তে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে নতুন সংঘাতের বলয় তৈরি করতে পারে বলে বৈঠকে আলোচিত হয়।
মঙ্গলবার সারাদেশের সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের যে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ হওয়ার কথা সেখানেও বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সভাটির মূল ভেন্যু ঢাকার সেনাপ্রাঙ্গণ। ঢাকার বাইরে থেকে সেনাবাহিনীর সকল কর্মকর্তা অনলাইনে বৈঠকে যুক্ত থাকবেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান গত মাসে জাতিসংঘ প্রস্তাবিত করিডোরে সরকারের ‘নীতিগত সম্মতি’র কথা বলেছিলেন। তাদের মতে, এই করিডোর রোহিঙ্গা ও অন্যান্য বিপন্ন জনগণের জন্য ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর রাস্তা।
এর আগে কক্সবাজার সফরে গিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের সংঘাতপূর্ণ রাখাইনে বিপন্ন মানুষের জন্য মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
অন্তর্বর্তী সরকার জাতিসংঘের প্রস্তাবে নীতিগত সম্মত থাকার কথা জানানোর পর থেকেই রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষক মহলে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল একে দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ বলে বর্ণনা করে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও প্রশ্ন তুলেছেন, ত্রাণ পৌঁছানো কি আদতেই এই করিডোরের একমাত্র উদ্দেশ্য?
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ড. মো. সরোয়ার হোসেন টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি করিডোর প্রতিষ্ঠা করা হলে সেখানে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
‘ওইসব অঞ্চলে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যদি মিয়ানমার সরকার মনে করে যে, প্রস্তাবিত করিডোরের মাধ্যমে আরাকান আর্মি কৌশলগতভাবে লাভবান হচ্ছে, তবে তারা নিশ্চুপ থাকবে—এমনটি প্রত্যাশা করা বাস্তবসম্মত নয়,” বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তার আশঙ্কা যে, এতে সংঘাত আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। “প্রস্তাবিত করিডোরটি আমাদের জন্য পরবর্তীতে একটি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবেও দেখা দিতে পারে।”
পশ্চিমা বিশ্বও বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকার একাধিক পশ্চিমা কূটনীতিক মিশন নিজ নিজ দেশকে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্ব করিডোরটিকে কৌশলগত প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে। সামরিক নেতৃত্ব মনে করছে, ‘মানবিক করিডোর’ এমন একটি ভৌগোলিক চৌকি যেখান থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিরাপত্তা ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
চীনের পক্ষ থেকেও অনানুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের অখণ্ডতার পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা রাখাইন ইস্যুতে বিদেশি হস্তক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে না। রাখাইনকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেও তারা উল্লেখ করেছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোরের জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবটি মূলত মানবাধিকার সুরক্ষা ও ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী এ করিডোরটি যুদ্ধ বা সহিংসতার মধ্যে আটকে পড়া বেসামরিক জনগণের জন্য একটি নিরাপদ পথ তৈরি করবে।
করিডোরটি নিশ্চিত হলে তা বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করবে বলে মনে করে জাতিসংঘ। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, রাখাইনে চলমান সংঘর্ষে হাজার হাজার রোহিঙ্গা, রাখাইন বৌদ্ধ ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী নিরাপত্তাহীনতা এবং আশ্রয়হীনতার পাশাপাশি দুর্ভক্ষ অবস্থায় পড়েছে। এই জনগোষ্ঠীর নিরাপদে সরে যাওয়া ও সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে করিডোর প্রয়োজন।

পাশাপাশি এটাও বলা হচ্ছে যে, জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা রাখাইনে সরাসরি প্রবেশ করতে পারছে না। করিডোর প্রতিষ্ঠা করলে খাদ্য, পানি, ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসরণ করে জাতিসংঘ ‘মানবিক করিডোর’কে একটি নিরপেক্ষ ও অ-সামরিক উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির আওতায় পরিচালিত হবে।
জাতিসংঘ এটাও দাবি করছে যে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকটসহ আন্তর্জাতিক উদ্বেগ প্রশমনে রাখাইনের ভেতরেই সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে প্রস্তাবটি করা হয়েছে যাতে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর চাপ কমে।
জাতিসংঘের মহাসচিবের বিবৃতি অনুযায়ী রাখাইনে প্রতিবন্ধকতাহীন মানবিক সহায়তা প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার পাশাপাশি সংঘর্ষে আহত বা আটকে পড়া লোকজনের চিকিৎসা এবং আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার সীমিত কার্যকারিতা রয়েছে।
চলমান সংঘর্ষমূলক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মানবিক করিডোরের প্রস্তাবকে ‘জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা’ হিসেবে দাবি করা হচ্ছে যদিও অনেক রাষ্ট্র এর কৌশলগত দিক নিয়ে শঙ্কিত।
বাংলাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এর ব্যতিক্রম নয়।