এবার হ্যান্ডমাইক নিয়ে একাই অন্যরকম যুদ্ধে নেমেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা’ খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল। ৭৩ বছর বয়সে আবারো হয়েছেন প্রতিবাদে সোচ্চার। ময়মনসিংহ শহরের ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে খর রোদের ভেতরে দৃঢ় কণ্ঠে প্রচার করছেন ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার অমর কীর্তির কথা।
আর এই রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার নামে করা সেখানকার স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করেছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। বুধবার (২৩ এপ্রিল) এক আদেশে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এর নতুন নাম এখন ‘জেলা স্টেডিয়াম, ময়মনসিংহ’। আর এটিই ক্ষুব্ধ করেছে বিমল পালকে।
বিমল পালের হ্যান্ডমাইকে একক প্রতিবাদের একটি লাইভ ভিডিও এরইমধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়েছে। সাথে সাথে সোচ্চার হয়েছেন হাজারো মানুষ। অসংখ্য প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যে তারা জানাচ্ছেন সংহতি।
আমার প্রতিবাদের ভাষা
তিনি একক প্রতিবাদে যা বলছেন, তা অনেকটা এরকম: ‘আমি বিমল পাল, আপনারা দেখেছেন, ময়মনসিংহের অনেক সমস্যা নিয়ে এই ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে বিভিন্ন সময় আমরা প্রতিবাদ করেছি। আজ আমি একা, এই ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রবাদ পুরুষ, ময়মনসিংহের কৃতীসন্তান, মরহুম রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার নামে ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল।’
‘আজ রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া নেই। আজ তার নামে যে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল, আপনারা জানেন, আজ থেকে দুই-তিনদিন আগে ক্রীড়া উপদেষ্টা একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নামকরণ বন্ধ (বাতিল) করে দিয়েছেন।’

বিমল পাল বলেন, ‘ইতিহাসের পাতা থেকে আওয়ামী লীগের প্রবাদ পুরুষ রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার নাম কোনদিন মোছা যাবে না। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, স্টেডিয়ামের নাম পুনরায় প্রতিষ্ঠা হোক। পাশাপাশি বলতে চাই ইউনূস সরকারকে, আপনারা ময়মনসিংহের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে যেসব নাম, সে সব পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন না। যেমন আপনারা জানেন, ময়মনসিংহের আরেক প্রবাদ পুরুষ আছেন আবুল মনসুর। যিনি ৫৪র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার নামে ময়মনসিংহে সড়ক আছে। আমরা চাই না তার নাম ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। আমি চাই না, এ সড়কের নাম পরিবর্তন হোক।’
তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা জানেন, মুক্তিযুদ্ধের যে মুজিবনগর সরকার, তার উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে এখানে কলেজ আছে। আমরা ইউনূস সরকারকে বলতে চাই, আপনারা কোনো মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ নামগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন না। আপনারা চেষ্টা করবেন না, আলমগীর, মনসুর, মিন্টুর নামে– যিনি ‘৬৯ এর শহীদ, এইসমস্ত নামগুলো (পরিবর্তন) থেকে আপনারা বিরত থাকবেন।’
বিমল পাল আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি আশা করি, ময়মনসিংহের সচেতন নাগরিক, এই বিষয়ে আপনারা কথা বলবেন। আজকে শুধুমাত্র আমি একা দাঁড়িয়ে এ কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের যে সংগঠক ছিলেন, এই কথাটি ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া যাবে না।’

‘সংগ্রামী জনগণ, আপনারা ধৈর্যসহ আমার কথাটি শুনেছেন, এ জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমার এ কথাটি শেষ করছি,’ উপসংহার টানেন তিনি।
রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া সম্পর্কে উইকিপিডিয়া বলছে, তিনি (২৫ জানুয়ারি ১৯২৮–২৩ মার্চ ১৯৯৬) ছিলেন বাংলাদেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক। ময়মনসিংহ-১৩ ও ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অবদানের পাশাপাশি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক হিসেবে তিনি পরিচিত।
শুধু যে তার জন্যই বিমল পাল সোচ্চার হয়েছেন এমন নয়। শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে শিশুদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের জানা-অজানা কাহিনী তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় তিনি নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছেন। উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের দাবি জানিয়ে।
২০২২ সালে ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের’ জন্য ৩০০ কিলোমিটার হেঁটে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল হইচই ফেলেন সারাদেশে। সে সময় তার ওই দীর্ঘ পদযাত্রাটি ১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসের মুজিব চত্বর থেকে শুরু হয়ে জেলার মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল, গফরগাঁও, নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট, ফুলপুর, তারাকান্দা হয়ে ১০ ডিসেম্বর (ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস) আবারও জেলা সদরে প্রবেশ করে। তার সঙ্গে সে সময় ওই পদযাত্রায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিক, নারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, চিকিৎসক আইনজীবী, প্রকৌশলী, বুদ্ধিজীবীসহ শত শত সাধারণ মানুষ অংশ নেন।
দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও মুক্তির জয়গান গেয়ে বিমল পাল এর আগেও আরো তিনবার এরকম পদযাত্রা করেছেন।
সবশেষ, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় গত ১ আগস্ট সোচ্চার হয়েছিলেন বিমল পাল। নির্বিচারে গুলি ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ এবং কারফিউ প্রত্যাহারের দাবিতে সে সময় তার নেতৃত্বে ময়মনসিংহে হয় ‘দ্রোহযাত্রা কর্মসূচি’। প্রতিবাদী এ মিছিল ও সমাবেশে সেদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ জানান।
বরাবরই তিনি যে ‘ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে’ প্রতিবাদী হয়েছেন, সেই চত্বরটি ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্র গাঙিনারপাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৯০’র ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের দু’জন শহীদের নামে। সেখানে সবশেষ তিনি রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তনের প্রতিবাদে একাই কণ্ঠ তুলেছেন।
‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সরকারকে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে’
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ‘মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা’ বিমল পালের এ প্রতিবাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
টাইমস অব বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামের’ নাম পরিবর্তন খুবই আপত্তিকর ও উদ্বেগজনক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত স্থাপনা, চিহ্ন ও নামকরণ রক্ষা করা সরকারের কর্তব্য।’
‘এ ধরণের নাম পরিবর্তন বা মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া মানে ফ্যাসিবাদী চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া, যা মেনে নেওয়া যায় না’, যোগ করেন তিনি।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেই জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে এ সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাই সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। অবিলম্বে ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামের নামকরণ বাতিল করে আগের নাম ফিরিয়ে দিতে হবে। নইলে তা হবে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে খুশী করার চেষ্টা, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’