
বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে সেনা অভিযানে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ‘কুকিচিন ন্যাশনাল আর্মি’ (কেএনএ) কমান্ডার ‘ক্যাপ্টেন’ পুতিন, ওরফে লাল মিন সাং (২৭) গত বছর রুমায় ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুট অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নিহত কমান্ডারের পরিচয় নিশ্চিতের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
আর কমান্ডার পুতিনের নিহত সহযোগীর নাম লাল হিম সাং বম (২৫)। কেএনএ’র ‘সৈনিক’ পদের এই ব্যক্তির সাংগঠনিক নাম আহিম। রুমা উপজেলার মুন্নুয়াম পাড়ার বাসিন্দা তিনি।
পাহাড়ের সূত্রগুলো বলছে, রুমায় ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের পর দলবল নিয়ে পিছু হটে ভারতের মিজোরামে পালিয়ে গেলেও সম্প্রতি আবার ছোট একটি উপদল নিয়ে পাহাড়ের গহিন অরণ্যে ফেরত আসেন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী কমান্ডার পুতিন। চেয়েছিলেন নতুন করে সশস্ত্র তৎপরতা গড়ে তুলতে। কিন্তু এর আগেই বৃহস্পতিবার ভোরে সেনা অভিযানে সহযোগীসহ মারা পড়েন তিনি। উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র, গুলি, সামরিক সরঞ্জাম ও নথিপত্র।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম দিকে কেএনএ’র একজন তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন রুমার মুয়ালপি পাড়ার বাসিন্দা লাল মিন সাং। সাহসকিতার বিবেচনায় তাকে সামরিক শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ‘ব্যাংক অপারেশন’-এর ‘দক্ষতায়’ ফিল্ড কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।
তার পরিবার কর্তা ইতা জওথান বম অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে অনেকদিন আগেই মিজোরামে চলে গেছেন।
বৃহস্পতিবার ভোরে রুমা উপজেলার দুর্গম মুলপি পাড়ার পাহাড়ে সেনাবাহিনী এবং কেএনএ’র মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে সহযোগীসহ কমান্ডার পুতিন মারা পড়লেও তার দলের কিছু গেরিলা সদস্য পালিয়ে যেতে পেরেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তৎক্ষণিকভাবে পুতিনের দলীয় বাহিনীর পদমর্যাদা হিসেবে ‘মেজর’ বলা হলেও শুক্রবার জানা গেছে, তিনি কথিত ‘ক্যাপ্টেন’ পদমর্যাদার ছিলেন।
কেএনএ’র ‘হাইড আউট’ থেকে অস্ত্র উদ্ধার
সেনাবাহিনী জানিয়েছে, উভয় পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে সহযোগীসহ মারা পড়েন কমান্ডার পুতিন। আর তার অপরাপর সহযোগীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অভিযানে একাধিক ‘হাইড আউট’ বা গোপন আস্তানার সন্ধান মিলেছে। পাওয়া গেছে অস্ত্র-শস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম।
অভিযানে সেনাবাহিনী ৩টি এসএমজি, ১টি চাইনিজ রাইফেল, ৮টি ম্যাগজিন, ৯ দশমিক ৯৬ মিমি. বল এ্যামো ১৫৪ রাউন্ড, ৩৯ মিমি. এ্যামো ২৩৭ রাউন্ড, ৫৪ মিমি. এ্যামো ৬০ রাউন্ড, ৩ সেট ইউনিফর্ম, ৮টি স্মার্ট ফোন, ৭টি বাইবেল, ওয়ারলেস সেটসহ সামরিক সরঞ্জামাদি উদ্ধার করেছে। পাশাপাশি অভিযানে বেশকিছু দলিলপত্রও পাওয়া গেছে।

অভিযানে নেতৃত্বদানকারী ও রুমা সেনা জোনের কমান্ডিং অফিসার (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলমগীর জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া সাব-মেশিন গানের (এসএমজি) মধ্যে একটি চীনের তৈরি, বাকি দু’টি মিয়ানমারের তৈরি। আর রাইফেলটি তৈরি চীনের।
তিনি বলেন, ‘অস্ত্রগুলোর নিবন্ধন ও ক্রমিক নম্বরের সূত্রে এগুলোর উৎস জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
গত বছর রুমায় সোনালী ব্যাংক শাখায় ডাকাতির পাশাপাশি পুলিশের যেসব রাইফেল লুট হয়েছে, উদ্ধার হওয়া রাইফেলটি তার একটি কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে লে. কর্নেল আলমগীর বলেন, উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারা খতিয়ে দেখার পর এটি নিশ্চিত করা সম্ভব।
বৃহস্পতিবার ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলমান রয়েছে। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি পরিচালিত অভিযানে অভিযুক্ত ২৩ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানের সময় এক সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন।
কর্নেল শফিকুল বলেন, ‘সেনাবাহিনী দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছে।’
যেভাবে কেএনএ’র উত্থান
পাহাড়ের সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী নাথান বম পাহাড়ের ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বাধীন কুকি রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ২০২২ সালে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেন। প্রথমে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’ নামক আঞ্চলিক দল, পরে খোলা হয় এর সামরিক বিভাগ কেএনএ। তখন থেকে অনেকটা প্রকাশ্যেই তারা ফেসবুক ও ইউটিউবে সশস্ত্র তৎপরতা প্রচার করছিল।

এর দু’বছর পর সরকারের সঙ্গে ‘শান্তি সংলাপ’ চলমান থাকা অবস্থায় ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল হঠাৎ রুমায় সোনালী ব্যাংক ডাকাতি ও পুলিশের ১০ অস্ত্রশস্ত্র লুট করে কেএনএফ সদস্যরা পালিয়ে যায়। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন বৃহস্পতিবার সেনা অভিযানে নিহত কেএনএ কমান্ডার, ‘ক্যাপ্টেন’ পুতিন।
সশস্ত্র গ্রুপটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ইসলামী জঙ্গিগ্রুপগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কাছে অস্ত্র কেনাবেচার অভিযোগ রয়েছে।
রুমায় ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় কেএনএফ-এর তৎপরতা। তবে কথিত ‘ফিল্ড মার্শাল’ নাথান বমের নেতৃত্বে আগেই সীমান্ত পেরিয়ে এর গেরিলা সদস্যদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে মিজোরাম হয়ে মনিপুরে।
সে সময় নিরাপত্তা অভিযানের কারণে ভয়ে অন্ততঃ তিন হাজার বম নারী-পুরুষ গ্রাম ছাড়া হন বলে স্থানীয়ভাবে দাবি করা হয়। অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ২৮ পাহাড়ির মধ্যে নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জন কারা হেফাজতে মারা গেছেন।
সবশেষ, বৃহস্পতিবার সেনা সদর দপ্তর জানিয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ১৩৮ জন বম নিজেদের এলাকায় ফিরে এসেছেন।