‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতোই পহেলা বৈশাখকে আমন্ত্রণ জানায় বাঙালিরা। পুরোনো দিনের ব্যর্থতা আর গ্লানি মুছে নবজাগরণের প্রতীক হয়ে আসে বাংলা নববর্ষ। নতুন ভোরের পর শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, ইলিশ-পান্তাসহ নানান আয়োজনে উদযাপন করা হয় এই প্রাণের উৎসব। প্রকৃতিতে যথারীতি ছড়িয়েছে বৈশাখের আগমনী বার্তা। চারদিকে এখন উৎসবের রঙ। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথমবার পহেলা বৈশাখ উদযাপন হতে যাচ্ছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায়।
বর্ষবরণের আয়োজনগুলোর মধ্যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আকর্ষণ বরাবরই অন্যরকম। এতে বাঙালি জাতির নানান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজের অবক্ষয় ও গোঁড়ামি থেকে মুক্তির আহ্বান জানানো হয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’৷ তবে এবার এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রা’। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হবে আনন্দ শোভাযাত্রা। এতে থাকছে বড়, মাঝারি ও ছোট সাতটি করে মোট ২১টি মোটিফ। এরমধ্যে ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি’ বহুল আলোচিত। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার পর আবার এটি তৈরি করেছেন চারুকলার শিল্পীরা।

বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রায় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিরা অংশ নেবেন। শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের সড়ক দিয়ে আবার চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে শোভাযাত্রা।
ঢাবি জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্য কেবল নীলক্ষেত ও পলাশী মোড় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা যাবে। শোভাযাত্রা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য প্রবেশপথ ও এর সংলগ্ন সড়ক বন্ধ থাকবে। নিরাপত্তার স্বার্থে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে মুখোশ পরা, ব্যাগ বহন করা, ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা যাবে না। তবে চারুকলা অনুষদের বানানো মুখোশ হাতে নিয়ে শোভাযাত্রায় প্রদর্শন করা যাবে।
শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নির্দেশনা অনুযায়ী, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে শাহবাগ মোড় হয়ে ডানে গিয়ে কাঁটাবন ক্রসিং হয়ে নীলক্ষেত মোড় দিয়ে ভিসি বাংলো মোড়ে যোগ দেওয়া যাবে। নিউমার্কেট দিয়ে আসা লোকজন নীলক্ষেত হয়ে ভিসি বাংলো মোড়ে সংযুক্ত হতে পারবেন। পলাশী দিয়ে আসা লোকজন পলাশী হয়ে নীলক্ষেত মোড় থেকে ডানে গিয়ে ভিসি বাংলো মোড়ে যোগ দিতে করবেন। চাঁনখারপুল ও বকশী বাজার হয়ে আসা লোকজন পলাশী মোড় হয়ে নীলক্ষেত থেকে ডানে মোড় নিয়ে ভিসি বাংলো মোড়ে যোগ দিতে পারবেন।
ছায়ানটের আয়োজন
ঢাকার রমনা উদ্যানে বাংলা ১৪৩২ বর্ষবরণ উদযাপন করবে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। সংগঠনের এবারের বার্তা, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। এটি হবে ছায়ানট আয়োজিত বর্ষবরণের ৫৮তম আয়োজন। ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ভৈরবীতে রাগালাপ দিয়ে ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাবে ছায়ানট। প্রভাতী আয়োজনে থাকছে ৯টি সম্মিলিত ও ১২টি একক গান এবং তিনটি পাঠ। সবমিলিয়ে দেড়শতাধিক শিল্পী অংশ নেবেন এই আয়োজনে।
হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণ
ঢাকার ধানমন্ডিতে রবীন্দ্র সরোবরে ভোর ৬টায় শুরু হবে চ্যানেল আই-সুরের ধারা হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণ। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলারা শিল্পীদের পাশাপাশি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীরা অংশ নেবেন।
কনসার্ট ও ড্রোন শো
ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে সোমবার বিকেল ৩টায় শুরু হবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত নববর্ষের কনসার্ট। সন্ধ্যা ৭টায় চীনা দূতাবাসের কারিগরি সহায়তায় থাকছে ড্রোন শো। এতে জুলাই আন্দোলনে প্রাণ হারানো আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধসহ বেশ কয়েকজনকে ফুটিয়ে তোলা হবে।
বৈশাখী মেলা
বাংলা একাডেমিতে পহেলা বৈশাখে শুরু হচ্ছে সপ্তাহব্যাপী বৈশাখী মেলা ও বইয়ের আড়ং। সোমবার সকাল ৮টায় নজরুল মঞ্চে রয়েছে বর্ষবরণ সংগীত। এরপর নববর্ষের বক্তৃতা রাখবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ ও বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। সকাল ৯টায় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বৈশাখী উৎসব
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভি আয়োজন করেছে বৈশাখী উৎসব। ঢাকার তেজগাঁওয়ে চ্যানেলটির কার্যালয় প্রাঙ্গণে সকাল ৯টা থেকে রয়েছে ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে বরণের এই অনুষ্ঠান।
পহেলা বৈশাখে ট্রাফিক নির্দেশনা
পহেলা বৈশাখ নির্বিঘ্নে ও আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপনের জন্য রাজধানীবাসীকে কিছু ট্রাফিক নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে ডিএমপি। এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সোমবার ভোর ৫টা থেকে রমনা পার্ক (রমনা বটমূল), সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় যানচলাচল নিয়ন্ত্রণে রাস্তা বন্ধ অথবা রোড ডাইভারশন দেয়া হবে। এগুলো হলো— বাংলামোটর ক্রসিং/নেভি গ্যাপ, পুলিশ ভবন ক্রসিং, সুগন্ধা ক্রসিং, কাকরাইল চার্চ ক্রসিং, কদম ফোয়ারা ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং (পূর্ব ও দক্ষিণ), দোয়েল চত্বর ক্রসিং, রোমানা ক্রসিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার, জগন্নাথ হল ক্রসিং, ভাস্কর্য ক্রসিং, নীলক্ষেত ক্রসিং ও কাঁটাবন ক্রসিং।

গাড়ি চলাচলের দিকনির্দেশনায় বলা হয়েছে, মিরপুর-ফার্মগেট থেকে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন বাংলামোটর ক্রসিং বামে মোড় নিয়ে মগবাজার ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে। গোলাপশাহ মাজার ক্রসিং-হাইকোর্ট ক্রসিং থেকে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন কদম ফোয়ারা ক্রসিং-ইউবিএল ক্রসিং- নাইটিংগেল ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে। সায়েন্সল্যাব ক্রসিং থেকে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন মিরপুর রোড দিয়ে আজিমপুর ক্রসিং-চাঁনখারপুল ক্রসিং-বকশীবাজার ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
গাড়ি পার্কিং করা যাবে নেভি গ্যাপ থেকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত, মৎস্যভবন ক্রসিং থেকে সেগুনবাগিচা পর্যন্ত (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি), শিল্পকলা একাডেমির গলি (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি), কাঁটাবন ক্রসিং থেকে নীলক্ষেত ক্রসিং হয়ে পলাশী ক্রসিং পর্যন্ত, দোয়েল চত্বর ক্রসিং থেকে শহীদুল্লাহ হল ক্রসিং পর্যন্ত ও আব্দুল গনি রোডে।