জুলাই ডায়েরি: ছুটির দিনেও বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ

টাইমস রিপোর্ট
5 Min Read
চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ৫ জুলাই শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।ছবি: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজ

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ৫ জুলাই শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে বিক্ষোভের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে। এ ছাড়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের এক পাশে মানববন্ধন করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা।

আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগ নীরব থাকলেও সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অনেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চলমান আন্দোলন থেকে তাদের বিরত রাখার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।

ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমকে ৪ জুলাই রাতে হলছাড়া করার চেষ্টা করা হয়।

সারজিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলে থাকতেন। তাকে জোর করে হল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। খবর পেয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ওই হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে হল কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এরপর সারজিস হলে তার কক্ষে আবার ফেরত যান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, ছাত্রলীগের একটি অংশ হামলা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দাবি আদায় থেকে তাদের বিরত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে।

২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের ছাত্র আন্দোলন হয়। এই আন্দোলন থেকে কোটা সংস্কারের দাবি উঠেছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি (২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর) করে। এর ফলে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়।

এরপর ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। সেই রিটের রায়ে হাইকোর্ট গত ৫ জুন সরকারি পরিপত্রের ওই অংশ (৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা) অবৈধ ঘোষণা করেন। এর পর থেকে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা আবার আন্দোলনে নামেন। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে। ঈদুল আজহার আগে কয়েক দিন বিক্ষোভের পর দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু দাবি পূরণ না হওয়ায় ১ জুলাই থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর ব্যানারে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা টানা আন্দোলন করেন। প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মিছিল বের হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে। এর মধ্যে ২ জুলাই বিকেলে এক ঘণ্টা, ৩ জুলাই বিকেলে দেড় ঘণ্টা এবং ৪ জুলাই দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।

৪ জুলাই পরিপত্র বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানির দিন ধার্য থাকলেও সেদিন শুনানি মুলতবি করা হয়। এরপর আন্দোলন আরও জোরদার করেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম  বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারের দায়িত্বশীল কোনো পর্যায় থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে তাদের আন্দোলন চলবে। আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রথমত ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে। এর বাইরে কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে আগের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে। অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য যৌক্তিক ও ন্যূনতম কোটা রাখা যেতে পারে। তবে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দিয়ে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে হবে। চাকরিতে একই কোটা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ছুটির দিনেও সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ
কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রাম শহরের ২ নম্বর গেট সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শহরের মুরাদপুর থেকে জিইসি যাওয়ার ব্যস্ততম সড়কটি ৫ জুলাই সাড়ে চারটার দিকে অবরোধ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শেষ করে ষোলশহর স্টেশন এলাকার দিকে মিছিল নিয়ে চলে যান।

বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গিয়ে শেষ হয়। পরে মহাসড়কের আরিচাগামী লেনে মানববন্ধন করেন তারা।

বিক্ষোভ করেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। বেলা দুইটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত প্রায় দেড় ঘণ্টা তারা গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া সড়ক অবরোধ করেন।

খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকায় বিকেলে অবরোধ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় জিরো পয়েন্ট এলাকার চারটি সড়কেই যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাসে ফিরে যান আন্দোলনকারীরা।

আন্দোলনে সমর্থন
কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। ৪ জুলাই বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে ‘যৌক্তিক ও ন্যায্য’ উল্লেখ করে সাদা দল।

সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানায় বাংলাদেশ জাসদ।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *