দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে একটি মানবিক করিডোর সুবিধা দিতে জাতিসংঘের অনুরোধ শর্তসাপেক্ষে মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ। এর উদ্দেশ্য মিয়ানমারে চলমান সংঘাতে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের কাছে মৌলিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতিগতভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তার এরকম ঘোষণায় নয়াদিল্লি থেকে ওয়াশিংটন, বেইজিং থেকে ব্রাসেলস এবং অবশ্যই নেপিদোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে এ নিয়ে যুগপৎ তৈরি হয়েছে আশাবাদ ও উদ্বেগ।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এখন বাংলাদেশের করিডোর পরিচালনা পরিকল্পনার দিকে নজর রাখছে। আর দেশের ভেতরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে— কিংবা আরও খারাপ অর্থে কোনো প্রক্সি যুদ্ধেই জড়িয়ে পড়বে কি না।
জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, জাতিসংঘ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাহায্য পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চায়।
তিনি বলেন, “আমরা নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছি, তবে কিছু শর্ত দিয়েছি। এটি একটি মানবিক করিডোর হবে। তবে কিছু শর্ত আছে। আমি বিস্তারিত বলব না। শর্ত পূরণ হলে অবশ্যই সাহায্য করব।”
তৌহিদ হোসেন আরও ইঙ্গিত দেন, ঢাকা এখানে কৌশলগত হিসাব-নিকাশও করছে। যার অর্থ বাংলাদেশের আশ্রয়ে থাকা প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসনের পথ সুগম করা।
তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সংঘাত বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমারের বহু মানুষ আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা চাই তারা ফিরে যাক। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য যা করণীয়, তা আমাদের করতে হবে।”
রাখাইনে ক্রমাগত মানবিক পরিস্থিতির অবনতি এই জরুরিতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী আরাকান আর্মির ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য রাখাইনে সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে মানবিক সংকট আরও তীব্র হয়েছে এবং জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসেবে বিবেচনা করছে।
তবে সামরিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, মানবিক করিডোর সাধারণত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য তৈরি হলেও এটি বিদ্রোহী ও অপরাধী চক্রের অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। রাখাইনের সীমান্ত এলাকা ইতিমধ্যেই অস্ত্র ও মাদক পাচারের জন্য কুখ্যাত।
এই উদ্বেগ প্রসঙ্গে তৌহিদ হোসেন বলেন, “এই করিডোর শুধুমাত্র পণ্য পরিবহনের জন্য; অস্ত্র পরিবহন করা হবে না।”
তবে বাস্তবে করিডোর পরিচালনায় সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো না কোনো মাত্রায় যোগাযোগের প্রয়োজন পড়ে। আর মিয়ানমারের জান্তা রাখাইনের বিশাল এলাকায় আরাকান আর্মির কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
তৌহিদ হোসেন স্বীকার করেন, “সম্পূর্ণ সীমান্ত এখন একটি অ-রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। আমরা তাদের সাথে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করতে পারি না। তবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকাও সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী যোগাযোগ রাখতে হবে।”
তবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন।
চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্রোহ দমনের অভিজ্ঞতা থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক বলেন, এ ধরনের করিডোর পরিচালনায় ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি এবং নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন: সাধারণত সামরিক লজিস্টিকস ফরওয়ার্ড ডিফেন্স লাইনের (এফডিএল) পেছনে থাকে। আর এ ধরনের অপারেশন এফডিএল-এর বাইরে হওয়ায় আলাদা প্রস্তুতি জরুরি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বেসামরিক নাগরিক ও যোদ্ধাদের আলাদা রাখার জন্য করিডোর নির্ধারণ করা হয়।
“তবুও বন্ধুবান্ধব আর শত্রুকে আলাদা করা অত্যন্ত কঠিন।”
তিনি বলেন, করিডোর দিয়ে সেবা প্রদানকারী বা সাধারণ নাগরিকের ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশের ঝুঁকি থাকবে। “তাদের গোপন উদ্দেশ্য, পরিচয়, উদ্দেশ্য কীভাবে শনাক্ত করবেন? কে কাকে সমর্থন করছে? কিভাবে নিশ্চিত হবেন তারা সত্যিকারে ক্ষতিগ্রস্ত কিনা?” — প্রশ্ন রাখেন রাজ্জাক।
যদিও বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অভিজ্ঞ, মাসুদ রাজ্জাক বলেন: একটি সরাসরি সংঘাতপূর্ণ এলাকায় দেশের ভেতরেই মানবিক করিডোর পরিচালনা করা হবে সম্পূর্ণ নতুন ও বহুগুণ বেশি জটিল চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, “যদি অনিবার্য হয়, তাহলে চরম সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। এনগেজমেন্টের নিয়ম কঠোরভাবে নির্ধারণ ও কার্যকর করতে হবে।”
বাংলাদেশের পরবর্তী সিদ্ধান্তের আগে এখন গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন রয়ে গেছে: করিডোর কি পুরোপুরি বাংলাদেশের সীমানার ভেতর থাকবে, নাকি মিয়ানমারের ভেতর প্রবেশ করবে? কে নিরাপত্তা কার্যক্রম তদারকি করবে? কীভাবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে মানবিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করবে?
জাতিসংঘের প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। তবে ভুলভাবে পরিচালিত হলে বাংলাদেশ একটি অস্থিতিশীল সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে পারে, যা জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করবে এবং যে শরণার্থী সংকট সমাধান করতে চায়, তা আরও জটিল করে তুলবে বলে সতর্ক করেছেন জেনারেল রাজ্জাক।