প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আজকের অস্থির বিশ্বে এশিয়ার সামনে রয়েছে একটি নতুন মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাজব্যবস্থার পথ দেখানোর এক ঐতিহাসিক সুযোগ।’
বৃহস্পতিবার জাপানের রাজধানী টোকিওতে ৩০তম নিক্কেই ফোরাম: ‘ফিউচার অব এশিয়া’র উদ্বোধনী অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে ‘উত্তাল বিশ্বে এশিয়ার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেশনে বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস তার বক্তব্যে আরো বলেন, ‘বিশ্ব ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে, শান্তি ভঙ্গুর, বৈশ্বিক আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়েও জাতিগুলো বিভক্ত, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে, জনগণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ছে।’
বিশ্বের চলমান সংকটের প্রেক্ষাপটে তিনি ইউক্রেন, গাজা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের উদাহরণ তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি সম্প্রতি ভয়াবহ ভূমিকম্প সেখানে মানবিক সংকট আরও গভীর করেছে। আর আমাদের দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধ ছিল ছোট কিন্তু ব্যয়বহুল। এসব ঘটনায় কোটি কোটি ডলার যুদ্ধে ব্যয় হচ্ছে, অথচ মানুষ মৌলিক চাহিদার জন্য সংগ্রাম করছে।’
বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশে এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তার মাধ্যমেই আমরা অন্তর্বর্তী সরকারে এসেছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে—ন্যায়বিচার, মর্যাদা, সাম্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ সুগম করা।’
ইউনূস জানান, গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেও বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান রাখছে এবং মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে।
ভাষণে তিনি তার বহুল আলোচিত ‘থ্রি জিরো ভিশন’ পুনরায় তুলে ধরেন—শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ। ইউনূস বলেন, ‘এটা কোনো স্বপ্ন নয়, এটা একটি লক্ষ্য, যা অর্জনে সরকার, ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে অংশ নিতে হবে। সমাজব্যবস্থার কাঠামোতেই পরিবর্তন আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষ কষ্ট পেতে জন্মায় না। মানুষ অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়—শুধু দরকার সুযোগ। আমরা যদি মুনাফার পেছনে না ছুটে সমস্যার সমাধানে ব্যবসা করি, তাহলে একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব।’
ড. ইউনূস এশিয়ার জন্য সাতটি প্রধান প্রস্তাবনা তুলে ধরেন—
‘আন্তঃনির্ভরশীলতাকে সহযোগিতায় রূপান্তর: এশিয়ার বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি, এই বৈচিত্র্যকে বিরোধ নয়, সহযোগিতায় রূপ দিতে হবে।’
‘অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সংহতি: এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে কম সংযুক্ত অঞ্চলগুলোর একটি, এই পরিস্থিতি পরিবর্তন না করলে সম্ভাবনা বাস্তবায়ন হবে না।’
‘অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষমতায়ন: দারিদ্র্য দরিদ্ররা সৃষ্টি করে না—ব্যবস্থাই দারিদ্র্য তৈরি করে। সেই ব্যবস্থা পাল্টাতে হবে।’
‘মানবসম্পদে বিনিয়োগ: অবকাঠামো নয়, মূল বিনিয়োগ করতে হবে মানুষে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সামাজিক ব্যবসায়।’
‘সবুজ রূপান্তর: বাংলাদেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী। একটি সর্ব-এশীয় সবুজ রূপান্তর প্রয়োজন।’
‘তরুণদের শক্তি ব্যবহার: তরুণদের শুধু চাকরির সন্ধান না করে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে হবে—‘চাকরি খুঁজো না, তৈরি করো।’
‘নৈতিক নেতৃত্ব ও জনসম্পৃক্ততা: শুধু অর্থনৈতিক শক্তি নয়, এশিয়া হতে পারে একটি নতুন নৈতিক কম্পাস—শান্তি, ন্যায় এবং মানবিক মূল্যের পক্ষে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা বলে, মানুষকে বিশ্বাস ও সম্মান দিলে, তারা শুধু শ্রমিক নয়, রূপান্তরকারী হয়ে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘নিক্কেই ফোরাম কেবল একটি সম্মেলন নয়, এটি একটি আশার প্ল্যাটফর্ম। এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো লেখা হয়নি—চলুন, আমরা একসাথে তা লিখি। বাংলাদেশ ও জাপান যৌথভাবে এশিয়া ও বিশ্বের ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারে।’