নিজে কোনো সংঘাতে না থাকলেও উপমহাদেশে যে রণদামামা, তাতে মাত্রই স্বৈরতন্ত্র দূর করে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে থাকা বাংলাদেশ কি কোনো ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে?
এরকম প্রশ্ন উঠছে কারণ একদিকে পারমাণবিক শক্তির দু’ দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা, অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ। বাংলাদেশের চারপাশ ঘিরে যুদ্ধের দামামা দক্ষিণ এশিয়াকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য একসঙ্গে দুই প্রান্তের যুদ্ধাবস্থা বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
তবে, অতটা শঙ্কিত না হতে বলছেন কেউ কেউ।
বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন: ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেরই পারমাণবিক সক্ষমতা আছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা বড় যুদ্ধে জড়াবে না। হয়তো পাল্টাপাল্টি স্ট্রাইকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।’
বুধবার রাতে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানে অন্তত ২৬ ‘বেসামরিক নাগরিক’ নিহত এবং আরও ৪৬ জন আহত হন বলে দাবি করেছে পাকিস্তান। ভারতের এনডিটিভি অবশ্য নিহতের সংখ্যা ৭০ বলছে। গত মাসে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহেলগামে এক বন্দুক হামলায় ২৬ জন নিহতের জেরে পাকিস্তানে ওই হামলা চালায় ভারত।

এতে এখন দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। তবে এর পেছনে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন: আগামী বছর বিজেপি বিহার ও পশ্চিমবাংলার ক্ষমতায় আসার জন্য যে জনমতটা তৈরি করতে চাচ্ছে, তার জন্য মুসলমানবিরোধী রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য জটিলতা বাড়াবে।
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, উপমহাদেশের যে কোনো ঘটনার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর থাকে এবং দেশের নাগরিকদের মধ্যেও এর নানাবিধ প্রতিক্রিয়া হয়।
এক বা একাধিক দেশের ঘটনায় প্রতিবেশী অন্য দেশের সরকারের নীতি গ্রহণে জনগণের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও বড় একটা ভূমিকা রাখে। সরকারের জন্য বিষয়টি বেশ ভাবনার। যেমনটা মনে করেন আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো ড. রুদাবা শহিদ।
এক বিশ্লেষণে তিনি সতর্ক করেন, দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকলে তা পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি বিশেষভাবে বাংলাদেশের সংকটময় অবস্থানের ওপর দৃষ্টি দিয়ে বলেছেন, ‘বিগত ভারতপন্থী শেখ হাসিনা সরকারকে সরিয়ে দিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার এখন ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকার একটি গভীরভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কাজ করছে। এ সময়ে বাংলাদেশে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাব কাজ করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ এবং শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেওয়ার কারণে জনমনে ক্ষোভও দিন দিন বাড়ছে।
তিনি বলেন: রাজনৈতিক ম্যান্ডেটহীন অন্তর্বর্তী নেতৃত্বকে একদিকে জাতীয়তাবাদী বা ভারতবিরোধী অবস্থান নেওয়ার জন্য নাগরিক সমাজের একটি অংশের চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অপরদিকে ভারতও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কাছ থেকে সমন্বয়মূলক অবস্থান আশা করছে। ফলে ঢাকা অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ এক কূটনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।’
এসবের পাশাপাশি অন্য চিন্তাও আছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেছেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের এই উত্তেজনায় পুরো অঞ্চলে সামরিকায়ন বাড়বে। যেহেতু দেশ দু’টি পাল্টাপাল্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে, বাংলাদেশের ওপরও সামরিক ব্যয় বাড়ানোর একটা চাপ তৈরি হতে পারে।’
‘এখন দরিদ্র দেশগুলোতে সামরিক ব্যয় বাড়া মানেই হলো গরিব মানুষের হিস্যা থেকে কিছু বরাদ্দ সামরিক খাতে চলে যাওয়া। এটা একটা বিপদের দিক,’ বলে মনে করেন তিনি।
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘বাংলাদেশের উচিত হবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোকে বলা যে, ভারত-পাকিস্তানের উচিত কাশ্মীর ইস্যুর সমাধান করা, কিংবা আন্তর্জাতিক মহলের উচিত এর মধ্যস্থতা করা। কারণ এই উত্তেজনা পুরো অঞ্চলের জন্যই হবে ক্ষতিকর।’
তবে বাংলাদেশকে যে শুধু ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিয়ে ভাবতে হচ্ছে এমনটা নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির অগ্রযাত্রা সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এ অবস্থায় দুই দিক থেকেই বাংলাদেশের সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।

তারা বলছেন, এখনও যেভাবে প্রতিদিন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশ ঘটছে, তাতে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তে নতুন করে মানবিক সংকটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালের মতো আরেকটি রোহিঙ্গা স্রোত নেমে এলে তা হবে বাংলাদেশের আরেকটি বড় বিপর্যয়, যাকে সামাল দেওয়া হবে খুবই কঠিন।
সমাধান হিসেবে আরাকানের বিপর্যস্ত মানুষদের জন্য জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ। কারণ হিসেবে ঢাকা মনে করছে, আরাকানে অস্থিরতা দূর হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে তা সহায়ক হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ এতদিন থেকেছে নিরপেক্ষ অবস্থানে। তবে এবার যুদ্ধ পরিস্থিতি দুই দিক থেকেই ঢাকা-কেন্দ্রিক কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক করিডোর দেওয়ার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা পক্ষে থাকলেও চীন ও রাশিয়া অবস্থান নিয়েছে জান্তার পক্ষে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ-ভারত শীতল সম্পর্কের ফাঁকে ইসলামাবাদের সঙ্গে ঢাকার কূটনৈতিক সখ্য বেড়েছে।
এরকম অবস্থায় কূটনীতির পাশাপাশি সামরিক ও কৌশলগত নানা দিক খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক মনে করেন, সংকট মুহূর্তে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নিরাপত্তা বাহিনীর মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকতে হবে।
মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে কূটনৈতিক তৎপরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, সবদিক থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক প্রতিটি স্তরে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
তাৎক্ষণিক লাভের পেছনে না ছোটার কথাও বলেছেন জেনারেল মাসুদ। ‘তাৎক্ষণিক সমাধান বা লাভের আশায় যেন পদক্ষেপ না নেওয়া হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে,’ মন্তব্য করে তিনি বলেন:
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সম্ভাব্য সুফল ও ক্ষতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পাশাপাশি আত্মসমালোচনামূলক বিশ্লেষণ জরুরি যেখানে নিজস্ব শক্তি, সামর্থ্য ও দুর্বলতা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
‘ভরসা বা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করলে হবে না। শুধু আশা কিংবা ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না, প্রস্তুতির ঘাটতিও চলবে না,’ মন্তব্য করে সাবেক এই মেজর জেনারেল বলেন: প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতিরোধক্ষমতা বা (deterrence capability) অর্জনের দিকে এগোতে হবে।
সেজন্য পরিকল্পনাটা কেমন হওয়া উচিত?
জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক বলেন: পরিকল্পনা হতে হবে স্থির ও বিস্তৃত। এটা একরকম ক্ষমতার খেলা—যেখানে জীবন, রাষ্ট্র এবং সীমান্ত জড়িত। এখানে আবেগ নয়, প্রয়োজন ধৈর্য, স্থিরতা ও সামগ্রিক পরিকল্পনা। পাশাপাশি সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকতে হবে, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে এবং বাণিজ্যিক চলাচলসহ সব ধরনের গতিবিধিতে নজরদারি বাড়াতে হবে।
এর এক বড় কারণ যে, যুদ্ধমুখর পরিস্থিতি সাধারণত জঙ্গি সংগঠনগুলোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বাইরের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে অস্থিরতা তৈরি হলে বাংলাদেশে নিষ্ক্রিয় থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলো পুনরায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন।
সেজন্য সতর্ক থাকার কথা বলেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল হক জানিয়েছেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয়, কোন জঙ্গি বা সন্ত্রাসী যেন এ দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সীমান্তের পুলিশ সুপারদের সতর্ক করা হয়েছে।
এসবের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতির দিকেও নজর রাখতে বলেছেন।
তারা মনে করেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণে দক্ষিণ এশিয়া থেকে পণ্য রপ্তানি ও বাণিজ্যিক চলাচল ব্যাহত হতে পারে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেলে বাংলাদেশও এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্দর ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি বাজার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। ব্যবসায়ীরাও এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।