জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এবার প্রথম মে দিবস বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। তাগিদ দেয় শ্রেণি বিভক্ত সমাজে মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিভাজনের অবসান ঘটিয়ে সমাজ সংস্কারের।
এই সেদিনও বাংলাদেশ স্মরণ করল গভীর শোকের সাথে রানা প্লাজা ট্রাজেডি (২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল), যে ‘পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের’ বিচার হয়নি এক যুগেও। এক ভবন ধসেই ঝরে গিয়েছে এক হাজার ১৩৮ শ্রমিকের প্রাণ। আহত আরো প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক। কারখানা দুর্ঘটনার ইতিহাসে এতো বেশি হতাহত আর কখনো হয়নি।
রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে শ্রমিক নিরাপত্তার প্রশ্নে টনক নড়েছিল বিশ্ব বিবেকের। তৈরি পোশাক ক্রেতা গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো পোশাক শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এর ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়ে গঠন করে অ্যাকর্ড। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো গঠন করে অ্যালায়েন্স।
বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম চলে ২০২০ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে তাদের অধিনে ৯২ শতাংশ কারখানার সংস্কার হয়। আর অ্যালায়েন্স ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কার্যক্রম চালায়। সে সময় তাদের আওতাধীন ৯০ শতাংশ কারখানার সংস্কার হয়েছিল।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা এখন তৈরি পোশাক কারখানায় সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি।
বিকেএমইএর এই নেতার আরো দাবি, ‘অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, সবুজ।’
এছাড়া সব কারখানার শ্রমিকের ‘বাঁচার মতো নূন্যতম মজুরি’র দাবি তো আছেই। পাশাপাশি ক্ষেতমজুর ও দিনমজুর নারী-পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরির দাবিও রয়েছে।
বহুমুখী শ্রমজীবী ও হকার সমিতির সভাপতি বাচ্চু ভূঁইয়া টাইমস অব বাংলাদেশকে জানান, তারা বরাবরই পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা দাবি করে আসছেন। তিনি বলেন, ‘কারণ বর্তমান বাজারে এর চেয়ে কম বেতনে একজন শ্রমিকের চারজনের একটি সংসার চালানো সম্ভব নয়।’
শ্রমিক নেতা বাচ্চু ভূঁইয়া অভিযোগ করে বলেন, ‘কিন্তু সরকার সব শ্রমিক সংগঠনের দাবি-দাওয়া উপেক্ষা করে ২০২৩ সালের নভেম্বরে এক তরফাভাবে শুধু পোশাক কারখানার শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা ঘোষণা করে, যা সব শ্রমিক সংগঠন প্রত্যাখান করেছে। আবার অধিকংশ কারখাতেই এই মজুরিটুকুও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সব মিলিয়ে শ্রমিকরা এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছে।’
তিনি জানান, তাদের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে, সব ধরনের শ্রমিকের জন্য আবাসন ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য বিশেষ রেশনিং সুবিধা চালুর দাবিও রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বাণী
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘মহান মে দিবস’ উপলক্ষ্যে দেওয়া বাণীতে বলেছেন, ‘মে দিবস শুধু একটি সাধারণ দিবস নয়, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ঐতিহাসিক এ দিনে যাদের আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে শ্রমিক অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে তাদেরসহ দেশের সকল মেহনতি মানুষের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।’
তিনি বলেন, ‘শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে মে দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বছর মে দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে’ আমাদের দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রমিক ও মালিক পরস্পরের পরিপূরক, আর তাদের যৌথ প্রচেষ্টাই একটি শক্তিশালী, আত্মনির্ভর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাক খাত, কৃষি, শিল্প, নির্মাণ, পরিবহণ, প্রযুক্তি – প্রতিটি খাতের উন্নতির পেছনে রয়েছে শ্রমিক এবং মালিকের মেধা ও প্রাণান্তকর পরিশ্রম। এ দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হলে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আস্থার পরিবেশ সুদৃঢ় করতে হবে। আমরা যদি ঐক্য ও সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখি, তাহলে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তব হয়ে উঠবে।’
তিনি জানান, এ বছর মহান মে দিবসের পাশাপাশি একইসঙ্গে সরকার ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস-২০২৫’ পালন করছে। এ বিষয়ে দেওয়া বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘শ্রমিকের ন্যায্য স্বীকৃতি ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা শুধু শ্রমিকদের অধিকারই নয়, এটি শিল্প ও অর্থনীতির উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। একইসঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন ও কল্যাণ পুরো শিল্পখাত এবং দেশের অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন-যাত্রায় শ্রমিক ও মালিকের অংশীদারিত্বে দেশের অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হবে মর্মে আমার বিশ্বাস।’

রক্তে ধোয়া মে, তোমায় সালাম
ইতিহাস বলছে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কোনো এক সময় অধিকার সচেতন হয়ে সংঘ গঠন করতে থাকে, যা ছিল সময়ের দাবি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্রম ঘণ্টা কমানো, ন্যায্য মজুরি প্রদান ও মানবিক জীবনযাত্রার জোর দাবিতে নেমে আসে রাজপথের আন্দোলনে।
১২ ঘণ্টা থেকে কর্মঘণ্টা কমিয়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা করার দাবি পূরণের দিন ক্ষণও নির্ধারণ করে উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন। ১ মে শ্রমিক কিংবা মে দিবস হিসাবে ঘোষণার দাবি আসে বিভিন্ন ট্রেড ইউনয়নের পক্ষ থেকে।
১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে জোটবদ্ধভাবে একত্রিত হয় অসংখ্য শ্রমিক, আন্দোলনরত শ্রমিকদের চারপাশে ছিল সরকারি পুলিশ বাহিনী। সেখানেই শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। শ্রমিকদের সভা থেকে বোমা বিস্ফোরিত হয় কর্তব্যরত পুলিশের ওপর। ঘটনাস্থলেই মারা যান এক পুলিশ কর্মকর্তা। পাল্টা পুলিশের গুলিবর্ষণে ১২ জন শ্রমিক নিহত হন বলে শ্রমিকদের দাবি।
এদিকে পুলিশ হত্যার দায়ে গ্রেপ্তরের পর বিচার প্রক্রিয়ায় ফাঁসিতে ঝুলানো হয় ছয় শ্রমিক নেতাকে। অভিযুক্ত আরেক বন্দি আত্মহত্যা করেন। অন্য জনের ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ১৭৮৯ সালে হয়ে যাওয়া ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন করা হয় ১৮৮৯ সালে।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নজরকাড়া সম্মেলন শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা পরম্পরা নিয়ে ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসে সমাজতন্ত্রীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, মজুরি বৈষম্যের অবসান ও ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নিশ্চিতের দাবিতে বিশ্বের শ্রমিক সংগঠনগুলো এক পতাকা তলে একতাবদ্ধ হওয়ার দাবি ওঠে। সেখানে সুনিশ্চিতভাবে ঘোষণা দেওয়া হয় ১ মে’কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের দৃপ্ত অঙ্গীকার।
সেই থেকে মে দিবস শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে যায়।