ভোরের সূর্য ততক্ষণে আলো ছড়িয়েছে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও পেটের তাগিতে পোশাক কারখানার কাজে গিয়েছেন ইয়ানূর। ভবন ধসে পড়ার সময়েও ছয় তলায় কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। মুহূর্তে ভবন ধসে চাপা পড়েন তিনি।
উদ্ধারের পর ইয়ানূরের দুই পায়ে ছয়টি সার্জারি করতে হয়। বাঁ পা এখনও প্রায় অকেজো। এক পায়ে টেনে চলেন জীবনের ভার। মেরুদণ্ডের ব্যথায় আজও সোজা হয়ে বেশিক্ষণ বসতে পারেন না। নানা শারীরিক জটিলতা তো আছেই!
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্রাজেডির নির্মম শিকার ইয়ানূরকে আজও তাড়া করে ফেরে সেই বিভীষিকা। ওই এক ভবন ধসেই ঝরে গিয়েছে এক হাজার ১৩৮ প্রাণ। ইয়ানূরের মত আহত হন আরো প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক। যারা এখনও বয়ে চলেছেন গ্লানিময় জীবন।

টাইমস অব বাংলাদেশকে ইয়ানূর বলেন, ‘আমরা ন্যায্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাই নাই। সংসার চালানোর মতো আর্থিক অবস্থা নাই। ১২ বছর হইয়া যাইতেছে, প্রতি বছরই আন্দোলন করতেছি। বলতেছি, আমাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেন, সুচিকিৎসা দেন, পুনর্বাসন করেন। কেউ আমাগো কথা কানেই লয় না!’
তিনি আহাজারি করে বলেন, ‘ছেলের মুখে এক মুঠ ভাত তুলে দেওয়ারও সামর্থ আমার নাই! এভাবে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে সেইদিনই কেন মরলাম না!’
দুর্ঘটনার দিন রানা প্লাজার চার তলায় কাজ করছিলেন কবির মোল্লা। ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে চার দিন চার রাত আটকা পড়েছিলেন তিনি। সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রায়ই ঘুমের ঘোরে ফিরে ফিরে আসে। আটকে পড়াদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখেছেন। দেখেছেন, পানির অভাবে প্রস্রাব খেয়ে সহকর্মীর প্রাণ রক্ষার চেষ্টা!
স্মৃতি হাতড়ে টাইমস অব বাংলাদেশকে কবির বলেন, ‘আমি ১৫ দিন সিএমএইচে ভর্তি ছিলাম। আর এখনও রাতে লাইট জ্বালায়া ঘুমাই, একা থাকতে পারি না। ওই আতঙ্ক ভুলার না!’
‘রানা প্লাজা ধসের ১২ বচ্ছরে ১২ টাকা তো দূরের কথা, এক টাকাও ক্ষতিপূরণ পাই নাই। আমাগো দেখার কেউ নেই!’
সাভারের শ্রমিক নেতা মো. সুজনের মতে, ‘রানা প্লাজা ট্রাজেডি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ড।’
তিনি বলেন, ‘দোষীদের শাস্তি ও হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে আমরা ১২ বছর ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। যতোদিন দাবি আদায় না হয়, ততদিনই আমরা দাবি জানাতে থাকব!’
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, ভবন ধসের এক বছর পর ২০১৪ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে রানা প্লাজায় হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল সে সময়ের আওয়ামী লীগ সরকার।

সেই কমিটির অন্যতম সুপারিশ ছিল– স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিকরা পাবেন ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা। আর যাদের একটি অঙ্গহানী হয়েছে, তারা পাবেন সাড়ে সাত লাখ টাকা। যাদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা প্রয়োজন, তারা পাবেন সাড়ে চার লাখ টাকা। আর মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা দেড় লাখ টাকা পাবেন।
শ্রমিকরা বলছেন, আবার সে সময় আহতদের কেউ কেউ কয়েকধাপে কয়েক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, এমন শ্রমিকও আছেন। কিন্তু তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক সংকটে তারা কোনো ভারী কাজ করতে পারেন না। বেশিরভাগ শ্রমিকেরই পেট চালানোই দায়। তার ওপর ওষুধ খরচের পাশাপাশি নিজ খরচে স্বাস্থ্য পরীক্ষা যেন দিবাস্বপ্ন।
রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে শ্রমিক নিরাপত্তার প্রশ্নে টনক নড়েছিল বিশ্ব বিবেকের। তৈরি পোশাক ক্রেতা গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো পোশাক শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এর ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়ে গঠন করে অ্যাকর্ড। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো গঠন করে অ্যালায়েন্স।
বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম চলে ২০২০ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে তাদের অধিনে ৯২ শতাংশ কারখানার সংস্কার হয়। আর অ্যালায়েন্স ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কার্যক্রম চালায়। সে সময় তাদের আওতাধীন ৯০ শতাংশ কারখানার সংস্কার হয়েছিল।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘রানা প্লাজার কোনো শ্রমিক যদি এখনও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে থাকেন, সেটা খুবই দুঃখজনক। সে সময় সরকারের তহবিলে পর্যাপ্ত টাকা ছিল, কাজেই এমন হওয়ার কথা না।’
‘তবে এমন অভিযোগও আছে, ভুয়া শ্রমিক সেজে অনেকে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে গেছে! এছাড়া এতদিন পর প্রকৃত শ্রমিক চিহ্নিত করাও কঠিন’, যোগ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমরা এখন তৈরি পোশাক কারখানায় সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি।’
বিকেএমইএ’র এই নেতার আরও দাবি, ‘অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, সবুজ।’