রাজনৈতিক পালাবদলের পর এবারের নববর্ষ উদযাপনে রয়েছে ভিন্ন আবহ। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পরিবর্তনের পর এটিই প্রথম বাংলা নববর্ষ। সেই প্রেক্ষাপটে নতুন চেতনায় এবারের আয়োজন। এ বছর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
এর অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’র মোটিফ। মূল মোটিফটি নাশকতায় পুড়ে গেলে এটি আবারো নির্মাণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এছাড়া নানা ঐহিত্যবাহী মোটিফের পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানের শহীদ মুগ্ধ স্মরণে বিশালাকৃতির পানির বোতলের মোটিফ ও ‘৩৬ জুলাই’ লেখা মোটিফ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের নজর কাড়ে। শোভাযাত্রায় স্থান পেয়েছে ফিলিস্তিনের সাথে সংহতি জানানো ‘টুকরো তরমুজ’র মোটিফ, যা ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকার প্রতীক (লাল, সবুজ ও সাদা রং) হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এবারের শোভাযাত্রায় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, দেশি-বিদেশি অতিথি, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। শোভাযাত্রায় ছিল ৭টি বড়, ৭টি মাঝারি ও ৭টি ছোট মোটিফ।
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে স্বাগত জানাতে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ স্লোগানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় ঐতিহ্যবাহী ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন হাজারো মানুষ, উৎসব মুখর পরিবেশে।
চারুকলা অনুষদের সামন থেকে যাত্রা শুরু করে শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড়, টিএসসি, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর ঘুরে আবারও চারুকলায় এসে শেষ হয়।
নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তৎপর। পুরো এলাকায় মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ, শোভাযাত্রার রুটজুড়ে নেয়া হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’
এদিকে, নববর্ষ ১৪৩২-কে বরণ করে নিতে রাজধানীর রমনার বটমূলে সূর্যোদয়ের পর শুরু হয় ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ভোরের আলো ফুটতেই সোমবার (১৪ এপ্রিল) ভোর সোয়া ৬টায় আহির ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে সূচনা হয় এবারের আয়োজনের।
ছায়ানটের রমনার আয়োজনের মূল সুর ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। আলো, প্রকৃতি, দেশপ্রেম এবং মানবিকতার সুরে সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠানটি। বৃক্ষবেদীর পূর্ব-পশ্চিমে অর্ধবৃত্তাকারে তৈরি করা ৭২ ফুট দীর্ঘ ও ৩০ ফুট প্রশস্ত মঞ্চে চলে ছায়ানটের ৫৮তম নববর্ষ আয়োজন।
চট্টগ্রামে বর্ষবরণের মঞ্চ ভাঙচুর, বাতিল অনুষ্ঠান
বর্ষবরণের দেশজুড়ে নানা কর্মসূচির মধ্যেই চট্টগ্রাম নগরীর ডিসি হিলে পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চ ভাঙচুরের পর বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বাতিল করেন আয়োজকরা। রোববার (১৩ এপ্রিল) রাতের দিকে নগরীর কোতোয়ালি থানার ডিসি হিলের নজরুল স্কয়ারে অনুষ্ঠানস্থলে এ হামলা হয়।
পুলিশের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানায়, অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে দাবি করে দুর্বৃত্তরা এ হামলা চালায়। হামলাচেষ্টার অভিযোগে ৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
অনেক বছর ধরে ‘সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের’ ব্যানারে চট্টগ্রামের ডিসি হিলে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। ৪৭ বছর পর অনুষ্ঠানটি বাধাগ্রস্ত হলো।
পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ আলী টিটু জানান, রাত পৌনে ৮টার দিকে ৩০-৪০ জন যুবক ‘স্বৈরাচারের দোসরেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’ স্লোগান নিয়ে মঞ্চের দিকে আসেন। একপর্যায়ে তারা ডেকারেশনের কাপড়, ব্যানার ও মঞ্চের পেছনের কাপড়ও ছিঁড়ে ফেলেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আলমগীর হোসেন জানান, এ ঘটনায় ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদেরকে থানায় নেওয়া হয়েছে।
দেশজুড়ে নানা আয়োজন
এর বাইরে পহেলা বৈশাখে সারাদেশের শহরে-নগরে তো বটেই, দেশের নানা প্রান্তে নানা আঙ্গিকে পালিত হচ্ছে দিনটি। এ উপলক্ষে জেলা জেলায় হয় শোভাযাত্রা। বসে মেলা, আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব মেলার অন্যতম আকর্ষণ কারুপণ্যের পাশাপাশি গৃহস্থালির নানা প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, শিশু-কিশোরদের খেলনা, ঢোল, বাঁশি, একতারা, শৌখিন সামগ্রী ইত্যাদি। মুড়ি, মুড়কি, খৈ, চিড়া, তেলে ভাজা তো আছেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠি নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে পালন করছেন চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণ। বাংলা বর্ষবিদায় ও নববর্ষকে স্বাগত জানাতে পাহাড়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ‘বৈসুক’, মারমা জনগোষ্ঠী ‘সাংগ্রাই’ ও চাকমা জনগোষ্ঠী ‘বিঝু’ নামে পালন করে আসছেন ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব। আদ্যক্ষর নিয়ে উৎসবটিকে বলা হয়– ‘বৈসাবি’। গত কয়েকদিন ধরে পাহাড়ের ঘরে ঘরে চলছে বৈসাবি উৎসব।
রাঙামাটিতে শনিবার (১২ এপ্রিল) সকালে চৈত্র সংক্রান্তিতে বৈসাবির বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। পরে চাকমাদের তিন দিনের সামাজিক উৎসব ‘বিঝু’র প্রথমদিন ‘ফুল বিঝুতে’ শিশু-কিশোর ও নারী-পুরুষ ঐতিহ্যবাহী সাজপোশাকে কাপ্তাই লেকে ফুল ভাসিয়ে কল্যাণ ও শান্তির জন্য প্রার্থণা করেন। পরদিন ‘মূল বিঝু’তে বাড়ি বাড়ি ঘুরে অতিথিরা পান-ভোজন করেন। আর বিঝুর শেষদিনে সোমবার (১৪ এপ্রিল) ‘গজ্যপজ্য বিঝু’তে সকলে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
আরেক পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে বৈসাবি উপলক্ষে মারমা জনগোষ্ঠি আয়োজন করেছে ছয়দিনব্যাপী বর্ষবরণ উৎসব ‘সাংগ্রাই’। মারমা উন্নয়ন সংসদ জানিয়েছে, সোমবার পহেলা বৈশাখে (১৪ এপ্রিল) ‘সাংগ্রাই’ এ আয়োজন করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী পানি খেলা, যেখানে তরুণ-তরুণীরা একে অপরের দিকে মৈত্রেয় পানি ছিটিয়ে পুরনো গ্লানি দূর ও নতুন জীবনের সূচনা করবে বলে বিশ্বাস করা হয়।
এছাড়া পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে ১০টি ঐতিহ্যবাহী খেলার, যার মধ্যে রয়েছে আলারি (খৈয়াৎ), রিআক্যাজা ও পানি খেলা। এসব গ্রামীণ খেলায় অংশ নিচ্ছেন নানা বয়সী মানুষ। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
রাঙামাটি ও বান্দরবানেও চলছে সাংগ্রাই, বিহু, বিষু, চাংক্রানসহ ঐতিহ্যবাহী নানা সামাজিক উৎসব।