‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ খেতাবপ্রাপ্ত মডেল মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার ও তাকে ঘিরে উদ্ভূত ঘটনা এখন দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তার বিরুদ্ধে সৌদি রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিককে ‘হানি ট্র্যাপ’ ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ উঠেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সন্দেহ, বাংলাদেশ-সৌদি সম্পর্ক নষ্ট করতেই ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে’ এ কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছিল।
বিশেষ ক্ষমতা আইনে মডেল ও অভিনেত্রী মেঘনাকে বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) গ্রেপ্তার ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠানোর পরদিন পুলিশের পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে সরাসরি ‘আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা’র অভিযোগ আনা হয়।
এ দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা করা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাকে অপহরণ করার অভিযোগ সঠিক নয়। তথাপি আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার তার রয়েছে।’
সৌদি রাষ্ট্রদূতের অভিযোগ ও ‘বাগদান’ বিতর্ক
গোয়েন্দা তদন্তে বিদায়ী সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফের কাছ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার দাবি ও গোপন সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে মেঘনার বিরুদ্ধে। পরিবারের দাবি, মাত্র ছয় মাসের পরিচয়ের মধ্যে তাদের ‘গোপনে বাগদান’ হয়েছিল, যা পরে ভেঙে যায় রাষ্ট্রদূতের অতীত সম্পর্কের তথ্য জানাজানির পর। এ নিয়ে মেঘনা ক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষতিপূরণ ও দুঃখপ্রকাশ দাবি করেন, যা অস্বীকার করেন রাষ্ট্রদূত।
কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক, উপহার ও ব্ল্যাকমেইল
পুলিশ জানিয়েছে, সৌদি দূত ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তত চারটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল মেঘনার। তার বিরুদ্ধে দামি গাড়ি, এয়ার টিকিটসহ বিভিন্ন উপহার নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেলিব্রিটি পরিচয়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে পরে তিনি ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করতেন বলেও অভিযোগ।
রাষ্ট্রদূত বিপর্যয় ও সরকারের অবস্থান
সৌদি রাষ্ট্রদূত নিজে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অভিযোগ জানান। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ মেঘনার যোগাযোগ এবং উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করে। সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হলে গ্রেপ্তার করা হয় মেঘনাকে।
গ্রেপ্তার ও সমালোচনা
ডিবি পুলিশের মেঘনাকে গ্রেপ্তার ও এক মাসের আটকাদেশে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় নেটিজেনদের পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ ৩৮ বিশিষ্ট নাগরিক মেঘনার মুক্তির পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিতে বলেছে, এ আইন ‘বিচারবহির্ভূত ও মানবাধিকারের পরিপন্থী’।
মেঘনার সহযোগী রিমান্ডে
চাঁদাবাজির মামলায় মেঘনার সহযোগী ও ব্যবসায়ী মো. দেওয়ান সমিরকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার (১২ এপ্রিল) তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ব্যবহার করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
এ দিন পাবলিক প্রসিকিউটর ( পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী অভিযোগ করে বলেন, ‘নারীদের ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে আসছেন আসামি দেওয়ান সমির। তার বিরুদ্ধে সৌদি রাষ্ট্রদূতের কাছে ৫ মিলিয়ন ডলার চাঁদা দাবির অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে শুক্রবার (১১ এপ্রিল) ভাটারা থানা–পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।’
কে এই মেঘনা আলম?
ভিকারুননিসা থেকে এইচএসসি ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করা মেঘনা ২০২০ সালে ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ বিজয়ী হন বলে জানা গেছে। উদ্যোক্তা হিসেবে ‘মিস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তার পরিবারের অভিযোগ, ‘বিনা অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
দৃশ্যতই, মেঘনাকে আটকের ঘটনায় রাজনীতিক, মানবাধিকারকর্মী, কূটনীতিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা। গোয়েন্দাদের তদন্ত চলছে। তবে ‘হানি ট্র্যাপ’ ইস্যুতে বাংলাদেশ-সৌদি সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয়, তা সময়ই বলে দেবে।