অভিনেত্রী ও মডেল মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানোর ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে প্রতিবাদের ঝড়। বিশেষ করে মেঘনাকে আটকের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। সংস্কৃতি ও মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকরাও সোচ্চার হয়েছেন মেঘনা ইস্যুতে। তারা প্রশ্ন তুলেছেন সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। এ ঘটনায় সৌদি রাষ্ট্রদূতের সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ তুলে তির্যক মন্তব্য করছেন প্রতিবাদকারীরা।
তবে মেঘনা আলমকে ৩০ দিনের ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ রাখার ব্যাখ্যা দিয়েছে পুলিশ। শুক্রবার (১১ এপ্রিল) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাকে আটকের কারণ হিসেবে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত’ করা, ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা’র অভিযোগ আনা হয়েছে।
বুধবার (৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় মেঘনা আলম নিজেকে ‘নিরাপরাধ’ দাবি করে ফেসবুকে লাইভে এসে অভিযোগ করেন, পুলিশ পরিচয়ধারীরা তার বসুন্ধরার বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করছে। প্রায় ১২ মিনিট পর লাইভটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে তা মুছেও ফেলা হয়।
মেঘনার খবর জানতে স্বজনরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করলেও তারা নিশ্চিত তথ্য পাননি বলেও অভিযোগ। এরপর বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাত ১০টায় মেঘনাকে আদালতে তোলা হলে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠান বিচারক।

ব্রিটিশ মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ফেসবুকে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে এই সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হচ্ছে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে এই ধরনের গ্রেপ্তার বন্ধ করা নয়, বরং যখন তা ঘটে তখন দ্রুত নিজেকে সংশোধন করে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া। মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে আটক করা হয়েছে। এটি একটি কঠোর আইন, যা কোনও অপরাধের প্রমাণ প্রদানের প্রয়োজন ছাড়াই প্রথমে ৩০ দিনের জন্য আটক করার অনুমতি দেয়। তাকে আটক করার কারণ? এটা অস্পষ্ট। কিন্তু সৌদি আরব দূতাবাসের মধ্যে বিব্রতবোধ দেখে মনে হচ্ছে– স্পষ্টতই আটক করার বৈধ কারণ নেই।’
‘তাছাড়া, যতদূর আমি জানতে পেরেছি (যদিও আমি স্বাধীন ভাবে নিশ্চিত হতে পারিনি) ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আনার আগে তাকে ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। স্বীকার করার আগে পর্যন্ত গোয়েন্দা শাখা তাকে হেফাজতে রাখার তথ্য প্রত্যাখ্যান করেছে। পুলিশ তাকে আটক করার পর পুলিশ/এনফোর্সমেন্ট কর্তৃপক্ষ তার বাড়িতে গিয়ে আটকের সিসিটিভি ফুটেজ সরিয়ে ফেলেছে।’
প্রবাসী সাংবাদিক ও এক্টিভিস্ট তাসনিম খলিল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, ‘একজন নারীকে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করে “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা” রক্ষা করা হচ্ছে? অবিলম্বে মেঘনা আলমকে মুক্তি দিন এবং তাকে হয়রানি করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ক্ষতিপূরণ দিন। সৌদিরা তো আমাদের বাপ লাগে না যে তাদের রাষ্ট্রদূতের ইজ্জত রক্ষার জন্য আমরা আমাদের নাগরিককে জেলে রাখবো।’
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার আশফাক নিপুণ লিখেছেন, ‘মেঘনা আলমকে যে প্রক্রিয়ায় জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে হাজতে পাঠানো হলো, তার সাথে ২০২০ সালে কার্টুনিষ্ট কিশোর এবং লেখক মুশতাকের বলপূর্বক গুম এবং গ্রেপ্তারের ঘটনার বিশেষ কোন পার্থক্য নাই।’
‘এইসব বিশেষ ক্ষমতা আইন বিশেষ আশীর্বাদ হয়ে আসে বিশেষ বিশেষ মানুষদের জন্য, সাধারণ নাগরিকদের জন্য আসে আতংক হয়ে।’
‘ক্ষমতাশালীদের জন্য বানানো এইসব বিশেষ আইন অবিলম্বে বাতিল করা হোক, মেঘনা আলমকে মুক্ত করা হোক। তিনি যদি কোন অপরাধেও জড়িত থাকেন তাহলে সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা সম্পন্ন করা হোক।’
‘আমরা জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র এবং আইনব্যবস্থা চাই, দরজা জানালা ভেঙে আতংক ছড়িয়ে, চুপ করিয়ে দেয়া কোন রাষ্ট্র এবং আইনব্যবস্থা নয়!’, যোগ করেন আশফাক নিপুন।
মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার তীর্যক মন্তব্য করে লিখেছেন, ‘নওশাবা থেকে মেঘনা আলম। আওয়ামীলীগ এর সাইবার আইন আর ঊণিশশ চুয়াত্তর এর বিশেষ ক্ষমতা আইনটা ভালো! তাই না? এগুলো সব ঠিক– শুধু সংবিধানটা..?’

বাংলাদেশি নির্মাতা ঋতু সাত্তার তার ফেসবুক পোষ্টে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘পুলিশের সংস্কার না হবে? কবে?’
‘পরীমনিকেও এভাবে নিয়ে যেতে দেখেছিলাম পুলিশকে। যে বলেছিল তাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে– সে তার ইগো দেখাতে পেরেছে কারণ সরকার ছিল তার পকেটে। পুলিশ ছিল তার পকেটে। দিনের পর দিন আমাদের মাইগ্রেন্ট মেয়েরা সৌদি থেকে যৌন নির্যাতনের চরম সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরে যা আজ পর্যন্ত কোনদিন ডিপ্লোম্যাটিকেলি হ্যান্ডেল্ড হয়নি।’
‘আর এক নিঙ্কম্পুপ এম্বাসেডর একজন নারী এন্টারটেইনমেন্ট প্রফেশনালকে আবার ইগো দেখাল পরের দেশে বসে। যে দেশে এই কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু নির্যাতন আইনের নতুন সংশধনীর ৪ (১) এবং ৯ (খ) এর বিরুদ্ধে রিট করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে দু’পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে যদি যৌন সম্পর্ক হয় এবং পরে যদি আস্থার সম্পর্ক না থাকে এবং নারী যদি মনে করে তার সম্মানহানি হয়েছে তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।’
‘এই এন্টারটেইনমেন্ট কর্মী শুধু বলেছেন আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। সে তো কোন প্রতারণা করেনি। পাবলিকলি বলেছে তার যা বলার আছে। কারণ হয়তো উনি বুঝতে পারছিলেন এই লোকের ইগো উনি একা সামাল দিতে পারবেন না। তাহলে এটা পারিবারিক আদালতের মামলা। এটা তো ডিবি পুলিশের মামলা না। ওর এই অতি ইগো কেন সামাল দিতে পারল না, চাইল না আমাদের পুলিশ, ডিবি, সরকার জানেন? কারণ নারীটি বিনোদন বিষয়ক কাজের সাথে জড়িত।’
‘এইসব এদেশে পাল্টাবে বলে মনে হয় না’ উল্লেখ করেন ঋতু সাত্তার।
রোকসানা রুমা নামে একজন বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তাকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। শব্দগত সংস্কার হয়েছে বৈকি!’
এদিকে, শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক বার্তায় বলা হয়, ‘দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাকে অপহরণ করার অভিযোগ সঠিক নয়। তথাপি আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার তার রয়েছে।’
মডেল ও অভিনেত্রী মেঘনা আলম ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার এবং নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকার জন্য তিনি এ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।