অন্যায্য বাজার চর্চা, প্রতিযোগিতা বিরোধী চুক্তি এবং ভর্তুকি মূল্যনীতির মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করে তোলার অভিযোগ উঠেছে শীর্ষস্থানীয় টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোনের (জিপি) বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগ এনেছে রবি ও বাংলালিংকের মতো তুলনামূলক ছোট অপারেটরগুলো।
তারা বলছে, প্রতিযোগীদের দুর্বল করতে জিপি ভর্তুকি দিয়ে প্রকৃত দামের চেয়ে কম দামে তাদের সিম কার্ড বিক্রি করে। এতে দিন দিন টেলিকম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো।
চলতি বছরের শুরুতে রবি ও বাংলালিংক এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনে (বিসিসি) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করে।
গত বুধবারের শুনানিতে গ্রামীণফোন এ বিষয়ে বিসিসি’র হস্তক্ষেপের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে। জিপি কর্তৃপক্ষের যুক্তি, এসব বিষয়ে নজরদারি কার্যক্রম কেবল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) আওতায় পড়ে।
তবে বিসিসি কমিশন গ্রামীণফোনের এ যুক্তি খারিজ করে দিতে পারে বলে ধারণা করছেন টেলিকমিশন বিশ্লেষকরা। কারণ ২০১২ সালের প্রতিযোগিতা আইনে এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে কমিশনকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্পষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
রবির অভিযোগ ও গ্রামীণফোনের জবাব
রবি আজিয়াটার অভিযোগ অনুযায়ী, জিপি ‘প্রতিযোগিতা আইন’ ২০১২-এর ১৫ ও ১৬ ধারা লঙ্ঘন করছে। যেখানে প্রতিযোগিতা-বিরোধী চুক্তি ও ভর্তুকিমূলক মূল্যনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২০১৯ সাল থেকে বিটিআরসি জিপিকে এসএমপি অপারেটর হিসেবে ঘোষণা করলেও রবি দাবি করছে, জিপি এখনো প্রতিযোগিতা-বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
রবির চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণসহ জিপির বিরুদ্ধে বিসিসিতে অভিযোগ করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, কমিশন আইন অনুযায়ী যথাযথ তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
‘জিপি কমিশনের এখতিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আইন অনুযায়ী এ বিষয়ে কমিশনের এখতিয়ার সম্পূর্ণ পরিষ্কার’, বলেন এই রবি কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে গ্রামীণফোন। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, গ্রামীণফোন বাংলাদেশের প্রচলিত প্রতিযোগিতা আইন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে। টেলিকম খাত বিটিআরসি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা নিয়মতি বাজার কার্যক্রম, মূল্য নির্ধারণ ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা তদারকি করে থাকে।
এতে আরও বলা হয়, ‘আমরা একজন গুরুত্বপূর্ণ বাজার শক্তি (সিগ্নিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার-এসএমপি) অপারেটর হিসেবে আইন মেনেই কার্যক্রম চালাচ্ছি।’
বাজারে জিপির প্রভাব
২০২৪ সালের নভেম্বরে টেলিকমিউনিকেশন গ্রাহক বাজারে জিপির অংশীদারত্ব ছিল ৪৪ দশমিক আট শতাংশ, রবির ৩০ দশমিক তিন শতাংশ এবং বাংলালিংকের ২১ দশমিক পাঁচ শতাংশ। ২০২৩ সালে এ খাতের প্রায় ৪৯ শতাংশের আয় ছিল জিপির দখলে। ৯০ শতাংশের বেশি মুনাফা নিয়ে সে বছর জিপির মোট মুনাফা দাঁড়ায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যেখানে রবির মুনাফা ছিল মাত্র ৩২১ কোটি টাকা।
বাজার ঘনত্ব সূচক এইচএইচআই অনুযায়ী, টেলিকমিউনিকেশন খাতে জিপির একচেটিয়া ও প্রভাবশালী অবস্থান স্পষ্ট। সাধারণত এই সূচকে আড়াই হাজারের বেশি পয়েন্ট হলেই উচ্চ বাজার ঘনত্ব নির্দেশ করে। সেখানে জিপির এইচএইচআই সূচক ছিল তিন হাজার ৩৭৫ এবং মুনাফার বাজারে তিন হাজার ৭২৭।
সিম বিক্রি ও ভর্তুকি বিতর্ক
২০২৪ সালের জুলাইয়ে সিম কার্ডের ভ্যাট বেড়ে ৩০০ টাকা হওয়ার পরও জিপি কিছু এলাকায় ৪৭ টাকা বা ৩০ টাকায় সিম বিক্রি করেছে। অন্যদিকে রবির সিম বিক্রি হয়েছে ন্যূনতম ১১০ টাকায়।
রবির অভিযোগ, জিপি শুধু সস্তায় সিম বিক্রি করছে তাই নয়, বরং অতিরিক্ত কথা বলার সময় ও ফ্রি ডেটাও দিচ্ছে। এতে সিমপ্রতি ভর্তুকি দাঁড়াচ্ছে ৪৭০ থেকে ৫৩১ টাকা। ছোট প্রতিযোগীরা বিপুল ভর্তুকি দিয়ে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
এছাড়া, জিপি খুচরা বিক্রেতাদের কমিশনও ১২২ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে, বিপরীতে রবির কমিশন ৮৯ টাকা। এই কৌশল অবলম্বন করায় ২০২৪ সালের জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে জিপির গ্রাহক শেয়ার বেড়েছে এক দশমিক দুই শতাংশ।
জিপি অবশ্য দাবি করেছে, তাদের প্রতিটি সিমের দাম সর্বনিম্ন ৩৫০ টাকা। তবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ হিসেবে তারা গ্রাহকদের কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে, যা শিল্পখাতে বাণিজ্য ধরে রাখার প্রচলিত প্রথা।
এদিকে জিপির বিরুদ্ধে রবি সরব হলেও অনেকটাই নীরব বাংলালিংক। বুধবার বিসিসি’র শুনানিতে বাংলালিংকের পক্ষ থেকে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন না করে পরবর্তী শুনানিতে বিস্তারিত অভিযোগ উপস্থাপন করার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে।