কক্সবাজারে মানবপাচার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং ওয়ার্কিং গ্রুপ জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অঞ্চলে ৮৬টি মানবপাচারের ঘটনা ঘটেছে, যার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা পাচারের শিকার হয়েছেন। ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার আদালতগুলোতে অন্তত ৪৫২টি মানবপাচার মামলা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে।
মানবপাচার প্রতিরোধ পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাইব্যুনাল বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), আইনজীবী ও সুরক্ষা সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের জেলা পর্যায়ের মতবিনিময় সভায় থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সীমা জহুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ (ভারপ্রাপ্ত) মামুনুর রশিদ। মঙ্গলবার রাতে জেলা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জানানো হয়, ২০২৩ সালে সারা দেশে ১৩৭টি মানবপাচার মামলা নথিভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ৪৪ শতাংশ ভুক্তভোগী ছিলেন কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা, নয়তো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এই ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ ছিলেন পুরুষ, যা মানবপাচারের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত বৈচিত্র্য এবং নতুন ধরনের কৌশল ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। অনেক পুরুষ ভুক্তভোগীকে বিদেশে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয় এবং পরে তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়।
এতে আরও জানানো হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের হিসাবে ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মানবপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৪৬টি। এতে ১৯ হাজার ২৮০ জনকে আসামি করা হয়। তবে এসব মামলা বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে সাজা হয়েছে মাত্র ১৫৭ জনের। এদের মধ্যে মাত্র ২৪ জনকে যাবজ্জীবন ও ১৩৩ জনকে অন্যান্য মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। যদিও এসব মামলায় অনেকের বিরুদ্ধেই গুরুতর অভিযোগ ছিল। কিন্তু সে অনুপাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, মানবপাচার মামলায় এক শতাংশেরও কম আসামি বিচারের আওতায় এসেছে। বরং গেল ছয় বছরে এসব মামলায় তিন হাজারেরও বেশি মানুষ খালাস পেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি খালাস দেওয়া হয়েছে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে।
পর্যালোচনামূলক ওই সভায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের (ট্রাইব্যুনাল-২) বিচারক ওসমান গণি সাম্প্রতিক সময়ে তার আদালতে দায়ের হওয়া একটি মানবপাচার মামলার উদাহরণ তুলে ধরেন।
তিনি ভুক্তভোগী ও আসামিদের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘১৮ বছরের এক ছেলেকে একজন পাচার করে দেয়। সেই ছেলেকে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকাও আদায় করে। পরে জানা যায়, ওই ছেলেকে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এরপর ছেলেটা মারা গেছে বলে পরিবারকে খবর দেওয়া হয়।’
এ সভায় আরও আলোচনা করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের (ট্রাইব্যুনাল-৩) বিচারক সাইফুর রহমান, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আবুল মনসুর সিদ্দিকী, জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা হামিমুন তানজিম, সিনিয়র সহকারী জজ বেলাল উদ্দিন ও কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ আলম। মানবপাচার বিষয়ক তথ্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কেস ম্যানেজমেন্ট সমন্বয়ক সাফায়েত বিন কামাল।