ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি।
‘বাংলাদেশস মিসিং বিলিয়নস, স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট’ অর্থাৎ চোখের সামনে চুরি হয়ে গেছে বাংলাদেশের বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ; এই শিরোনামে প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের অনুসন্ধানী দলের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সেখানে তুলে ধরা হয়েছে, এই বিপুল অর্থ কীভাবে যুক্তরাজ্যে পৌঁছল তাও।
প্রামাণ্যচিত্রের শুরুতেই শেখ হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্র সমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি ও রেজওয়ান আহমেদ রিফাদ। তাদের ভাষায়, শেখ হাসিনার সরকার কেবল আওয়ামী নেতাকর্মী কিংবা তাদের সমর্থিত জনগণকেই কোটা সুবিধা দিত। আর আওয়ামী বিরোধীরা হতেন নিষ্পেষিত এবং নির্যাতিত।
রাফিয়া রেহনুমা হৃদি বলেন, ‘শুরুর দিকে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ ছিল না। কিন্তু ১৪ জুলাই পুলিশ রাস্তা অবরোধ করে। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দেয় এবং মারমুখী হয়। সম্মুখ সারির শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হাজতে নেয়। তারপরই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।’
ছাত্রনেতা রিজওয়ান আহমেদ রিফাত জানান, পুলিশ ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরাসরি গুলি, স্নাইপার শট ও হেলিকপ্টার থেকে শেল নিক্ষেপ করে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে অন্তত ১৪০০ প্রাণ নিভে গেছে। নিখোঁজ এবং আহত হন আরও কয়েক হাজার মানুষ।
নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন সশস্ত্র আক্রমণের পেছনে শেখ হাসিনা সরকারের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে দায়ী করেছেন এই ‘জুলাই যোদ্ধারা’।

প্রামাণ্যচিত্রে আরও দাবি করা হয়, শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে গণতন্ত্র নয়, বরং সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল এক ব্যক্তির হাতে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের শ্রমের অর্থ এক প্রকার ডাকাতি করে নিয়েছেন আওয়ামী নেতা-কর্মীরা। তারা মনে করতেন- এই অর্থ তাদের জন্য উন্মুক্ত এবং যেভাবে খুশি তা আত্মসাৎ করা যায়। আর দুর্নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠিত সে অর্থ দিয়ে তারা ভিনদেশে গড়ে তুলেছেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রাসাদ।
এমন দাবির স্বপক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ দিয়েছেন এফটি’র দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান জন রিড, সাবেক বাংলাদেশ-ভিত্তিক সাংবাদিক ও বর্তমানে এফটির কৃষি ও পণ্য বিষয়ক সংবাদদাতা সুজানা স্যাভিজ, স্পটলাইট অন করাপশন–এর উপ-পরিচালক হেলেন টেইলর এবং এফটি’র ওয়েস্টমিনস্টার লবি প্রতিবেদক রাফে উদ্দিন।
টলাইট অন করাপশন–এর উপ-পরিচালক হেলেন টেইলর বলেন, ‘যখন “মেগা করাপশন” হয়, তখন তা গোপন রাখা যায় না। এটি গোপন রাখার প্রয়োজনও পড়ে না। সবাই জানে দুর্নীতি হচ্ছে, অর্থ পাচার হচ্ছে, নৈতিকতা বিরোধী কাজ চলছে। তবুও ঠেকানোর কেউ নেই। এই প্রক্রিয়াই এক ধরনের “ক্লেপ্টোক্র্যাসি”। আর বাংলাদেশ ক্লেপ্টোক্র্যাসির সবচেয়ে বড় উদাহরণ।’
ওয়েস্টমিনস্টার লবি প্রতিবেদক রাফে উদ্দিনের সহায়তায় এফটি সাংবাদিক সুজানা স্যাভিজ বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের বড় অংশ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগ হিসেবে খুঁজে পান। সুজানা একসময় বাংলাদেশে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বস্ত, শীর্ষ পর্যায়ের বিভিন্ন গোপন সূত্রে অর্থপাচারের যোগসংযোগ খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন।

প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, একসময়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। ঐতিহ্যবাহী হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশনের অভ্যর্থনা সাইনবোর্ড তারই প্রমাণ। যেখানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় স্বাগত জানানো হয় স্টেশন ভ্রমণকারীদের। লন্ডনের ব্যস্ত রাস্তায় প্রায়ই চোখে পড়ে শতভাগ বাঙ্গালিয়ানা।
শেখ হাসিনা পরিবারের সঙ্গেও লন্ডনের সম্পর্ক বেশ গভীর। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহেনা ও তার সন্তানেরা ব্রিটিশ নাগরিক। শেখ রেহানার বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় লেবার এমপি। সম্প্রতি তিনি লেবার সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেিউরাফে উদ্দিনের ভাষায়, ‘আমরা যখন অনুসন্ধান শুরু করি, তখন রিয়েল এস্টেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে অফশোর সম্পত্তি ও পাচার হওয়া টাকায় বিনিয়োগের তথ্য খুঁজে পাই। হাজার হাজার তথ্যের মধ্যে আমরা দেখতে পাই টিউলিপ সিদ্দিকের নামে থাকা ফ্ল্যাট, যার কোনো হিসাব তিনি সরকারকে দেননি।’
‘তদন্তে জানতে পারি, বাংলাদেশের আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি ওই ফ্ল্যাটের মালিকানা টিউলিপ সিদ্দিককে হস্তান্তর করেন’, বলেন রাফে উদ্দিন।

এছাড়া, শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানায় কেবল যুক্তরাজ্যেই অন্তত ৩০০টির বেশি সম্পত্তি খুঁজে পায় ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস। বাংলাদেশের ‘বিজনেস টাইকুন’ এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলমও ব্যাংক লোনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যুক্তরাজ্যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে দাবি করেছে এফটি। এস আলম গ্রুপ একাই প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে বলে অভিযোগ মিলেছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ইতিমধ্যে বাংলাদেশিদের মালিকানায় থাকা ৩৫০টির বেশি সম্পত্তি চিহ্নিত ও জব্দ করেছে। তারা বলছে, প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে যুক্তরাজ্যে পাচার হয়েছিউএফটি’র দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান জন রিড জানান, কেবল অর্থপাচারই নয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে নজিরবিহীন ব্যাংকলুটের ঘটনা ঘটেছে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বিপুল ঋণ নিয়ে তা আর কখনও শোধ করেননি। শুধু তাই নয়, এই পুরো প্রক্রিয়া গোপন রাখতে এবং বিনা বাধায় শেষ করতে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকেও তারা নিজেদের অধীনে নিয়ে নিয়েছিলেন।
ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের দাবি, ডিজিএফআই (বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগী) -এর সহায়তায় প্রভাবশালী মহল ব্যাংক দখল করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তাদের ‘গানপয়েন্টে’ রেখে পরিচালক বদলাতেও বাধ্য করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আর এর পেছনে মদদদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাকে দায়ী করেন আব্দুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত ১১টি ব্যাংককে দেউলিয়ার পথে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রভাবশালীরা জোরপূর্বক পরিচালক পরিবর্তন করে নিজেদের লোক বসাত এবং ভুয়া কোম্পানিকে ঋণ দিত, যা ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।’

আওয়ামী সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্প- পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও শেখ হাসিনার নেতাকর্মীরা বিপুল অর্থ পাচার করেছে বলে মনে করছে এফটি।
ব্যাংক খাতের অচলাবস্থা দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি জানান, গ্রাহকের অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে দেওলিয়ার পথে থাকা ব্যাংকগুলোতে প্রাণ ফেরাতে ২৯০ বিলিয়ন তরলীকৃত টাকা সরবরাহ করা হয়েছে।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনার জন্য এরই মধ্যে “অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্স” গঠন করা হলেও পাচার হওয়া ২৩৪ বিলিয়ন ডলার দেশে ফিরিয়ে আনাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন এফটি’র বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পাচারকারীরা আন্তর্জাতিকভাবে অতি দক্ষ আর্থিক ও আইন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছেন। যারা ওই বিপুল অর্থ ও সম্পদকে বৈধ বলে প্রমাণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে সরকার তাদের সঙ্গে সেটেলমেন্ট বা আপসের মাধ্যমে টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করতে পারে।