বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও অনিশ্চয়তার আবহ। নির্বাচন কমিশন পুরোনো পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেও জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ফেব্রুয়ারির ভোট অনুষ্ঠান নিয়ে আপত্তি না জানালেও দিচ্ছে নানা শর্ত। তাদের দাবি, ভোট হতে হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতিতে।
কিন্তু সকলেই জানেন, পিআর পদ্ধতি চালু করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংসদ না থাকায় তা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ দাবির অন্তরালে রয়েছে মূলত নির্বাচনের তারিখ পেছানোর আকাঙ্ক্ষা।
আর এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনকে সম্মত করে সরকারকে দিয়ে ‘গণভোট’ করাতে চায় দলগুলো। একে কালক্ষেপনের চেষ্টা মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে পুরোনো কাঠামোয় সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। কমিশনের এ কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার দেখাতে চায় যে, তারা ফেব্রুয়ারিতেই ভোট আয়োজনে অটল।
গত সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস সাতটি দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেখানে বিএনপি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। কিন্তু জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন নানা শর্ত তোলে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, তারা এখনো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। নতুন করে ভোটের তারিখ পেছানোর পথ খুঁজছে এই তিনটি দল।

এ অবস্থায় পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, সব দিক বিবেচনায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা এখন ‘ফিফটি-ফিফটি’।
রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জন আছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ এই তিন দল নির্বাচনের সময় পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আরেকটি কৌশল নিয়েছে। সেটি হলো— বর্তমান সেনাপ্রধানকে পদে রেখে নির্বাচন না করা।
অবশ্য প্রকাশ্যে এ দাবি কেউ তোলেনি। কিন্তু আকার-ইঙ্গিতে প্রধান উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট মহলকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। যদিও নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী কমিশনের অধীনেই কাজ করে, তবু সেনাপ্রধানের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরিস্থিতি জটিল করার প্রয়াস নিচ্ছেন তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, সেনাপ্রধানের মেয়াদ ২০২৭ সালের জুনে শেষ হবে। তাই এ ইস্যুটি রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে নির্বাচনের তারিখ কয়েক বছর পিছিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

অন্যদিকে, বিএনপি সেনাপ্রধান ইস্যুকে প্রহসন মনে করছে। তারা জানে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকলে দেশ অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাবে। তাদের অভিযোগ, সংস্কারের নামে অনেক পদক্ষেপই সময়ক্ষেপণ ছাড়া কিছুই নয়। আইনশৃঙ্খলা থেকে অর্থনীতি–প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থতা স্পষ্ট।
বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা নতুন নয়। প্রায় প্রতিবারই নির্বাচনের আগে নানা কৌশল ও শর্তের খেলা চলে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না।
জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন প্রকাশ্যে পিআর দাবি তুললেও মূলত নির্বাচন পেছানোর দিকেই নজর দিচ্ছে বলে মনে হয়। সেনাপ্রধান ইস্যু সামনে এনে তারা সরকারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা এমন কোনো প্রচেষ্টার বিরোধিতা করবে।
ফেব্রুয়ারির নির্বাচন তাই কেবল ভোট আয়োজনের প্রশ্ন নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বড় পরীক্ষা। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি চললেও মাঠে আস্থাহীনতা বাড়ছে।
প্রশ্ন এখন একটাই, ফেব্রুয়ারিতে আসলেই ভোট হবে নাকি আবারও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে যাবে দেশ?