শিশুদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে ‘হাজেরা আম্মা’র লড়াই

টাইমস রিপোর্ট
6 Min Read
সন্তানদের সঙ্গে হাজেরা বেগম। ছবি: টাইমস

ঢাকার মোহাম্মদপুরের সুনিবিড় হাউজিং। সেখানে বেশ অনেকটা পথ যাওয়ার পর দেখা মেলে অতি সাধারণ চেহারার এক বাড়ির। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সাধারণ এই বাড়ির ভেতরেই চলে অসাধারণ এক কর্মযজ্ঞ। যে বাসাটি দিনভর মেতে থাকে শিশুদের হাসি-কান্না-আনন্দ-কলরবে।

বাসায় ঢুকতেই দেখা মিলল শিশুদের কেউ বই হাতে ছুটছে, কেউ তাদের ‘আম্মার’ আঁচল টেনে ধরছে, কেউ আবার হয়ত স্কুল থেকে ফিরেই ‘আম্মার’ খোঁজ করছে।

আর এই কলরবের ভেতর মধ্যমনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নারী, যার নাম হাজেরা বেগম। যিনি এই সব শিশুর ‘আম্মা’, অথচ এরা কেউই তার গর্ভ থেকে জন্ম নেয়নি।

১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া হাজেরা বেগম ছোটবেলা থেকেই নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। শৈশবে হারিয়েছেন পরিবার, সৎ মায়ের নির্যাতনে ঘর ছাড়তে হয়েছে সাত-আট বছর বয়সেই।

ঢাকার রাস্তায় রাত কাটাতে গিয়ে একসময় জড়িয়ে পড়েন যৌন পেশায়। জীবনের অন্ধকার পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেখেছেন অসংখ্য শিশুর কান্না, উপেক্ষা আর অনাহার। দেখেছেন কত শত চোখের জল।

জীবন সংকটে জর্জরিত হাজেরা নিজের অশ্রু লুকাতে গিয়ে একদিন অনুভব করলেন তার জীবনের আসল লড়াই হয়ত কেবল নিজের জন্য নয়, বরং এই অবহেলিত শিশুদের জন্য।

সেই উপলব্ধিই হাজেরা বেগমের হৃদয়ে জন্ম দিল এক নতুন স্বপ্নের। তিনি স্বপ্ন বুনলেন এই অবহেলিত শিশুদের আগলে রাখার, তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার।

২০০০ সালের দিকে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন যৌনকর্মীদের শিশুদের নিয়ে গড়ে ওঠা ‘দুর্জয় নারী সংঘ’-এর শিশু নিবাসে। পরে ২০০৮ সালে বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে সেই নিবাসের কার্যক্রম থেমে যায়। কিন্তু থেমে যাননি হাজেরা। নিজের সামান্য সঞ্চয় আর কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় শিশুদের পাশে দাঁড়ান তিনি।

২০১০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিশুদের জন্য আমরা’ পূনর্বাসন কেন্দ্রটি। শুরুতে মাত্র ২৫ জন শিশুকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী তখন তার পাশে দাঁড়ান, যা ছিল বড় সহায়তা। ২০১২ সালে সংগঠনটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে নিবন্ধিত হয়। ধীরে ধীরে আশ্রয় পাওয়া শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে হাজেরা বেগমের কাছে বড় হচ্ছে ৪৫টি শিশু।

যাদের মধ্যে ৩৫ জন যৌনকর্মীর সন্তান, আর ১০ জন শ্রমিক পরিবারের কিংবা অনাথ শিশু। এই শিশুদের সামলাতে হাজেরার সঙ্গে আছেন তিনজন কেয়ারগিভার ও একজন সহযোগী।

যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ২০০ জনেরও বেশি শিশু হাজেরার সংগঠনের সহায়তায় পড়াশোনা শেষ করে নানান পেশায় যুক্ত হয়েছে। ‘হাজেরা আম্মার’ কারণেই তাদের আর ফিরতে হয়নি নিজের মায়ের পুরোনো পেশায়।

এই শিশুদের কাছে হাজেরা বেগম কেবল মা নয়, বাবাও।

কথা হয় সীমা (ছদ্মনাম) নামে এক কিশোরীর সঙ্গে। সে বলে, ‘নিজের মাকে দেখি নাই। ছোটবেলা থেকে হাজেরা আম্মারেই দেখছি আমারে আদর করতে।’

আরেক শিশু শুভ বলে, ‘আগে আমি খাইতে পাইতাম না তিনবেলা। এখানে আম্মা আমারে প্রতি বেলায় খাওয়ায়। আমি এখন স্কুলেও যাই।’

প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত হাজেরা ছুটে বেড়ান শিশুদের হাসি, কান্না আর স্বপ্ন নিয়ে। কেউ অসুস্থ হলে তিনি দৌড়ে যান হাসপাতালে, কেউ পরীক্ষায় ভালো করলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন।

নিজের সন্তান না হলেও, এখানের প্রতিটি শিশুকে তিনি জায়গা দিয়েছেন নিজের বুকের ভেতর।

তবে হাজেরার সংগ্রাম শেষ হয়নি। এই শিশুদের খাবার, লেখাপড়া, চিকিৎসা আর বাড়িভাড়ার পেছনে মানে প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। এই অর্থ জোগাড় করাও এক ধরনের সংগ্রাম।

আমেনা ফাউন্ডেশন, খালেদ মনসুর ট্রাস্ট এবং নানা ব্যক্তিগত সহায়তা থেকে খরচের বড় একটা অংশ আসে বলে জানালেন হাজেরা।

তিনি বলেন, ‘এদের কেউ চাল দেন, কেউ কম্বল, কেউ বা পড়াশোনার খরচ বহন করেন। তবুও সব সময় যথেষ্ট হয় না এই সহায়তা।‘

‘ভাড়া বাসায় এতগুলো বাচ্চা সামলানো আমার জন্য খুব কষ্ট হয়ে যায়। যদি সরকার আমার বাচ্চাদের জন্য একটা জমি দিত, তাহলে ওদের জন্য একটা স্থায়ী ঘর বানাতে পারতাম। মানুষ যদি একটু হাত বাড়ায়, এই বাচ্চাগুলার জীবন বদলাইয়া যাবে।’

সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদক মশিউল আজম মিন্টু বলেন, ‘রাইট অ্যান্ড সাইট ফর চিল্ড্রেন (আরএসসি) নামের একটি সংস্থা আগে আমাদের ফান্ড দিত। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তারা তা বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে খাবার, শিক্ষাসামগ্রী, চিকিৎসা আর চোখের পরীক্ষা সবকিছু প্রভাবিত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংস্থার বয়স ১৫ বছর। ফান্ডিং ছাড়া এতগুলো শিশু দেখভাল করা কঠিন। আমরা চাই স্থানীয় মানুষ আরও এগিয়ে আসুক। তবে ভাড়া বাড়ার চাপ, ফান্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে আমরা চরম বিপাকে।’

সংস্থায় থাকা অনেক শিশুর জন্ম নিবন্ধন নেই। এজন্য স্কুলে ভর্তি বা সরকারি সেবা পাওয়ায় সমস্যা হয় বলেও জানান মিন্টু।

তিনি বলেন, ‘পরিচয় সংকট আছে এমন শিশুদের জন্ম নিবন্ধন সহজ করতে হবে। শিক্ষাসেবা, টিকা, এনআইডি সবকিছুর জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

কিন্তু এত সংকটের মাঝেও আশার আলো নিভতে দেন না ‘হাজেরা আম্মা’। তার আশ্রয়ে বড় হওয়া কোনো মেয়ে এখন পর্যন্ত যৌনপেশায় ফেরেনি। কেউ পোশাক কারখানায় কাজ করছে, কেউ সংসার করছে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অনেকে আবার ফিরে এসে ছোটদের পড়ায় সাহায্য করছে।

হাজেরা বলেন, ‘ওদের হাসি আমার সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। ওরাই আমার শক্তি।’

জন্ম না দিয়েও শত সন্তানের মা হয়ে ওঠা এই নারী বাংলাদেশের এক অন্যরকম মানবিকতার প্রতীক। যিনি নানা অনিশ্চয়তা আর সংকট মাথায় নিয়েও আগলে রেখেছেন শিশুদের। প্রতিদিন লড়ছেন ‘শিশুদের জন্য আমরা’র জন্য।

‘হাজেরা আম্মার’ প্রত্যাশা, সরকার আর সমাজ এগিয়ে আসবে, হাত বাড়িয়ে দেবে তার সন্তানদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *