চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি, চলছে মবোক্রেসি: ফখরুল  

টাইমস রিপোর্ট
16 Min Read
একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস
Highlights
  • ‘ফ্যাসিবাদকে সরানোর জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে কাজ করেছি। নির্বাচনে যেসব দল জয়ী হবে, তাদের নিয়ে আমরা একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই। সে ভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে বিএনপি মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি  ‘টাইমস অব বাংলাদেশ’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে খোলামেলা জবাব দিয়েছেন নানা প্রশ্নের; বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন ও জাতীয় সরকার, মব ভায়োলেন্স, শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চরিত্র, ৩২ নম্বরের ভাংচুর, বিএনপিতে খালেদা জিয়ার অবস্থান, তারেক রহমানের দেশে ফেরাসহ নানা বিষয়ে উঠে এসেছে সাক্ষাৎকারে। বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টাইমসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক অম্লান দেওয়ান ও বিশেষ প্রতিনিধি মোশাররফ বাবলু।

টাইমস অব বাংলাদেশ:  বিগত ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সফল হতে পারেনি বিএনপি।  জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। বিএনপি বিরোধী দলে থেকেও এতদিন আন্দোলন জোরালো করতে পারেনি কেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ১৭ বছর ধরে আন্দোলন করেছে বিএনপি। ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতা মাঠে নেমে আসায় আন্দোলন আরও বেগবান হয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

টাইমস: শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটাতে এত সময় লাগলো কেন?

ফখরুল: আওয়ামী লীগ একটা পুরোনো রাজনৈতিক দল এবং এই দলের একটা ভিত্তি আছে। এর আগে পাকিস্তান হওয়ার পরে ছিল মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ হয়েছে। পরবর্তীতে যিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসলেন, তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের কন্যা। সেটাকে জনপ্রিয়তা বলেন আর সুবিধা বলেন, সেটা তার ছিল। তারা যখন কাজ শুরু করে এবং তাদের নির্বাচনী ইশতেহার পূরণের দিকে তারা যাচ্ছিল।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। স্কেচ: টাইমস

এরপরেই অল্প সময়ের মধ্যে এরা অত্যন্ত অজনপ্রিয় ওঠে। তারা জনগণের উপরে নির্যাতন নিপীড়ন শুরু করে। তারা যে আর্থিক কেলেংকারী, লুটপাট শুরু করে সেটা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে দেখেনি। তারা আইনগুলো পরিবর্তন শুরু করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করে।

বিশেষ করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তৈরির কারণে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে যেকোনো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেসব আন্দোলন সফল হয়েছে তার সবগুলোতেই তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল।

এরপরেও আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে, বিরোধী দল হিসেবে বিরোধিতা করেছি। ফলে আমাদের উপর প্রথম থেকেই অত্যাচার-নির্যাতনের খড়্গ নেমে এসেছে। এই ১৬ বছরে আমাদের ৬০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। ১৭শ’ মানুষকে গুম করে ফেলা হয়েছে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে প্রথম পর্যায়ে সিলেট অঞ্চলের আমাদের জনপ্রিয় নেতা এমপি ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়। এরপর ঢাকা সিটিতে চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়েছে।

এইভাবে গুম ও খুনের যে রাজনীতি তারা শুরু করে, সেটি আরেকটা ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফ্যাসিবাদী কায়দায় টেলিফোন ট্র্যাক করে গ্রেপ্তার করা, জামিন না দেওয়া, এইসব করে একটা ভয়ের আবহ তৈরি করা হয়েছিল। দেশে তারা ভয়ের সংস্কৃতি কায়েম করেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যতক্ষণ রাজপথে বেরিয়ে না আসছে, ততক্ষণ কোনো আন্দোলন বাংলাদেশে সফল হয়নি। আমরা বারবার করে বলেছি যে, তরুণদের রাজপথে বের হয়ে আসা দরকার। তখন কিন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কোনো অংশগ্রহণ জাতীয় রাজনীতিতে আমরা দেখতে পাইনি। দলগুলো আলাদা ছোট ছোট আন্দোলন করেছে এবং ছাত্রদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিমুখ ছিল।

এরকম আচরণ আমরা আগে কখনো দেখিনি, তবে শেখ মুজিবের আমলে কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে। বাপকে ধরে নিয়ে ছেলের মাথা কাটিয়েছে, কাটা মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছে, তখন এ ধরনের ঘটনা তখন ঘটেছে।

এরপরে একটার পর একটা হত্যা, বিশেষ করে বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড অনেক ঘটেছে, যে কারণে আন্দোলনে বাধা এসেছে। এতো বেশি সময় লেগেছে। তবে যে মুহূর্তে ছাত্ররা মাঠে নেমেছে, তখনই সরকারের পতন হয়েছে।

একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস

টাইমস: শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনার মধ্যে রাজনৈতিক চরিত্রগত মিল-অমিল কী আছে বলে আপনি মনে করেন?

ফখরুল: দুজনের খুব বেশি একটা অমিল দেখি না। প্রায় একই চরিত্রের দুজন। দুজনই স্বেচ্ছাচারী। নিজেকে সবচেয়ে বেশি প্রধান করে দেখেছে। পার্টিও সেভাবেই তাদের অবস্থা তৈরিতে সাহায্য করেছে। ১৯৭১ এ শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে ছিলেন না, পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। এরপরে কি ঘটেছিল আপনারা জানেন। ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত আস্তে আস্তে শেখ মুজিবও একজন স্বৈরাচারী শাসকে পরিনত হন। ‘কোথায় আজ সিরাজ শিকদার’, ‘লাল ঘোড়া দাবড়ায়া দেব’,  তার এ সমস্ত কথাবার্তা কিন্তু আমাদের মনে আছে। তখনও গুম, খুন হয়েছে।

যার ফলে শেখ মুজিব ও তার মধ্যে রাজনৈতিক চরিত্রগত জায়গায় খুব একটা পার্থক্য নেই। শেখ হাসিনা একজন ধূর্ত নেতা ছিলেন। দলীয়করণ করে রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র তাকে সমর্থন দিয়েছিল। সেনাবাহিনীকেও ওই সময় তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ভারতবর্ষ হাসিনা সরকারকে বরাবরই পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। এটাও একটা কারণ ছিল। এখনো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। তবে এতে খুব একটা বেশি কাজ হবে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ আগে ‘অ্যান্টি ইন্ডিয়ান’ ছিল এখন ‘অ্যান্টি হাসিনা’ এবং ‘অ্যান্টি ইন্ডিয়ান’ দুই-ই হয়ে গেছে।

কারণ দেশে একটা গণহত্যা হয়েছে, হাসিনা গণহত্যা চালিয়ে সবচেয়ে বড় যে ভুল করেছে সেটার জন্য তার কোনো রকমের অনুশোচনা নেই। জনগণের কাছে একবার ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। এসব কারণেই উনি জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। দলকেই উনি দেখেছেন, জনগণকে দেখেননি।

একান্ত সাক্ষাৎকারের ফাঁকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস

টাইমস: এই যে হত্যার রাজনীতির অপসংস্কৃতি চলছে, এ থেকে বের হয়ে আসার উপায় কী?

ফখরুল: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এখানে গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। তবে একদিনে তো এটা করা যাবে না, গণতান্ত্রিক একটা প্রক্রিয়া লাগবে। নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ হবে। সংসদকে কার্যকর রাখতে হবে। সংসদে আলোচনা-সমালোচনা হবে।

যদি গণতন্ত্রের চর্চা থাকে, সংসদ থাকে, কমিটিগুলো কাজ করে, তখন রাজনীতিবিদদের কদর বাড়তে থাকে। রাজনীতিবিদদেরকে ছোট করে রাখা হয়েছে আমলাতন্ত্রের কাছে, আর আমলারা তার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা কখনোই সঠিকভাবে হয়নি।

টাইমস: শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা কথা বলি। কিন্তু এখন অন্তবর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এমনও বলা হচ্ছে, যে গত ১৫ বছরে যে দুর্নীতি হয়নি, গত এক বছরে তার চাইতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে!

ফখরুল: না, না–এটা ঠিক না। পরিকল্পিতভাবে এই প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। আমি বলব না যে, একদমই হচ্ছে না। হচ্ছে কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রিত। সবার কথা আমি বলতে পারবো না। তবে ৯০ শতাংশ নিজেরা সৎ এবং তারা সৎভাবে তাদের মন্ত্রণালয় চালাতে চায়। কয়েকটা মন্ত্রণালয়ে সমস্যা থাকতে পারে। তার কারণ আমলারাই। তারাই সেসব মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করছে, অনভিজ্ঞতার কারণে রাজনীতিবিদরা আমলাদের উপর নির্ভরশীল। যে কারণে আমলারা সুযোগটা নিচ্ছে।

একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস

বিগ মিডিয়া হাউসগুলো ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে কোনো স্বাধীনতা নাই। মালিক যা চাইবে, তাই আপনাকে বলতে হবে, লিখতে হবে। কিছু কিছু মিডিয়া ‘মবোক্রেসিকে’ উস্কে দিচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। ভালো জিনিসকে নেওয়ার ক্ষমতা তো আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। আপনি যদি সারাক্ষণ খারাপ কথা বলতে থাকেন, তাহলে খারাপই হবে।

টাইমস: এটাকে এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলা যায় কিনা?

ফখরুল: না, না! এটাকে সংস্কৃতি বলতে পারবেন না। এটা অপসংস্কৃতি।  গণতন্ত্রের চর্চা যখন হবে, একে অপরকে বকাবকি করবেন। তবে সেটা যদি আপনি অশ্লীল ভাষায় করেন, সেটা সংস্কৃতি না। এমন কিছু ব্যক্তি আছেন, যাদের নাম আমি বলতে চাই না, যেমন কোনো কোনো ইউটিউবার–যাদের ভাষা কানে নেওয়া যায় না।

টাইমস: ‘মব’ সন্ত্রাসের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙা হলো। এটা কতটুকু সমর্থনযোগ্য?

ফখরুল: এটা সমর্থনযোগ্য, কি সমর্থনযোগ্য নয়– এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। আমি মনে করি, এটা রাজনৈতিক সহিংসতা, এটা আমি সমর্থন করি না। আমি ‘লিবারাল ডেমোক্রেসির’ মানুষ। কোনটা ভাঙা, ঠিক আর কোনটা ভাঙা ঠিক নয়, এটা জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।

তবে তাদেরকে যদি ‘লেলিয়ে দেওয়া হয়’ তাহলে আপনি করবেনটা কী? প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে, যাও আক্রমণ করো, এটা ভাঙো, ওটা ভাঙো!

মূলত আমরা ‘ডেমোক্রেসি’ চেয়েছিলাম, আর এখন চলছে ‘মবোক্রেসি’!

একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস

টাইমস: বড় একটা আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। আন্দোলনে যারা জড়িত ছিলেন, এক বছরের মধ্যেই তাদের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়েছে। এর কারণ কী?

ফখরুল: এটা বঙ্গবাসীর স্বাভাবিক চরিত্র। কিছু মনে করবেন না। বাঙালিরা খুব সহজেই ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না। আপনি চারটা লোক এক জায়গায় করে দেখেন, ওখানেও তিনটা ভাগ হয়ে গেছে। এটা আমাদের চরিত্রগত সমস্যা আর কি!

টাইমস: এই বিভক্তির ফলে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ফিরে আসার পথ সুগম হতে পারে কী?

ফখরুল: হতে পারে। এটা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে কাজ করছে সেটার ওপর। সরকার যদি সঠিক সময়ে সঠিক কাজ না করতে পারে তবে ঝুঁকি বাড়বেই। আওয়ামী লীগ সুযোগ পাবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার, তারা আক্রমণ করার জন্য তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক।

টাইমস: লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর বোঝা গেল যে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে।

প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে হবে নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরপরও সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংশয়-সন্দেহ বাড়ছে কেন?

ফখরুল: রাজনৈতিক নেতা ও কয়েকজন উপদেষ্টার কিছু মন্তব্য, উক্তি– এর কারণ। ফলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন মাঝে মধ্যে ভালো কথা বলে, আর বেশিরভাগ সময় তারাও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। বাঙালি জাতি ১৫ বছর তারা গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত, নির্বাচন করতে পারে নাই, ভোট দিতে পারে নাই। সবসময় মনে একটা সন্দেহ-সংশয়।

একান্ত সাক্ষাৎকারের ফাঁকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস

টাইমস: রাজনৈতিক দলের নেতাদের মন্তব্য ও উক্তির ফলে যদি নির্বাচন পিছিয়ে যায় তাহলে তাদের কী লাভ হবে?

ফখরুল: আমি মনে করি কারোরই লাভ হবে না। নির্বাচন পেছানো হলে সকলেরই ক্ষতি হবে, জাতির ক্ষতি হবে।

টাইমস: বিএনপির ৩১ দফায় জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি আছে। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর অন্তবর্তী সরকার গঠন না হয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হলো না কেন?

ফখরুল: আমাদের ৩১ দফায় জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি আছে ঠিকই। তবে এখানে একটা ভুল বার্তা আছে। আমরা বলেছি, জাতীয় নির্বাচনের পরে যদি বিএনপি জয়লাভ করে, সবাইকে নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করব। কারণ নির্বাচিত দলগুলোকে নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই।

টাইমস: বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আছে। এরপরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন?

ফখরুল: বড় দলে এরকম অভিযোগ থাকবে, আগেও ছিল। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, এই অভিযোগ ঠিক নয়। রাতারাতি তো একেবারে একটা স্বর্গ তৈরি হয়ে যাবে না।

টাইমস: বর্তমানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম তো নিষিদ্ধ। এরপরও তারা নির্বাচন করতে চায়। তাদেরকে নির্বাচন করতে না দিলে নির্বাচন তো একপেশে হয়ে যাবে। তাই না?

ফখরুল: এটা তো আমাদের দায়িত্ব না। এই দায়িত্ব হচ্ছে আওয়ামী লীগের। তাদেরকে অন্তবর্তী সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সেটাকে তারা কীভাবে দেখবে?

তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করছে। আমরা তো মনে করি, বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে খুব একটা সমস্যা হবে না।

একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস

টাইমস: বিচার ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে পরস্পর দোষারোপ চলছে। আপনারা বলছেন, একটি গোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে যথাসময়ে নির্বাচন হবে কিনা?

ফখরুল: বিচার ও সংস্কার দুইই একসঙ্গে চলছে। তাদের কথা বলার অধিকার আছে। তবে আমি তো আগেই বলেছি যে, যথাসময়ে নির্বাচন না হলে দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে। জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

টাইমস: মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। তাকে কী দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা সম্ভব?

ফখরুল: গণহত্যা এবং মানবাধিকার অধিকার হরণের দায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ উঠেছে। তার বিচার তো হবেই। তার আমলে আমরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে রেখেছে। গুম, খুন করেছে।

টাইমস: বিএনপির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী?

ফখরুল: বিএনপির চ্যালেঞ্জ তো অনেকগুলো। নির্বাচনকে সামনে রেখে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ–সঠিকভাবে দলীয় মনোনয়নের জন্য কাজ করা। দলকে সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনমুখী করে তোলা। ইতোমধ্যে সেই কাজ শুরু হয়েছে।

টাইমস: বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উপযুক্ত। ক্ষমতায় গেলে এই দল কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে?

ফখরুল: আগামীর কথা চিন্তা করে সেই সম্পর্কে এখন থেকে ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করেছি। ফ্যাসিবাদকে সরানোর জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে কাজ করেছি। নির্বাচনে যেসব দল জয়ী হবে, তাদের নিয়ে আমরা একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই। সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস/টাইমস

টাইমস: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। জুলাই সনদকে সংবিধানের উর্ধ্বে স্থান দেওয়ার দাবি উঠছে। একদল বলছে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। এ অবস্থায় কীভাবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে?

ফখরুল: যেখানে গণতন্ত্র থাকবে, সেখানে মতবিরোধ থাকবে। নইলে সবগুলো রাজনৈতিক দল একটা কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে যেত, অথবা জামায়াতে ইসলামের মতো একটা জামায়াত ইসলাম হয়ে যেত।

যেখানে ওদের কোন মতভেদ থাকে না, থাকলে তা বাইরে আসতে দেয় না। আর আমাদের পার্টির মধ্যে  মতভেদগুলো বাইরে চলে আসে। এটা তো একটা ‘ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি’, কিন্তু এটা অস্বাভাবিক নয়। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে, তারা কোন রাজনৈতিক দলকে বেছে নেবে পরবর্তী সরকার হিসেবে। কাদেরকে তারা পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চায়।

ওইখানেও যে ঐক্য হবে, এটাও ভুল ধারণা।

টাইমস: ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে আপনাদের কী আলোচনা চলছে?

ফখরুল: আমরা আশা করি, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। বিগত সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুগপৎ আন্দোলনে শরীক ছিল, আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা হচ্ছে। আগেই বলেছি, আমরা শরীকদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করব।

টাইমস: আগামীতে বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, সেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থান কী হবে? উনি কি নির্বাচন করতে পারবেন?

ফখরুল: ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নির্বাচন করতে কোনো বাধা নেই। তবে তিনি অনেক অসুস্থ। তার চলাফেরা করতে অসুবিধা, কষ্ট হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তিনি এবং ডাক্তাররা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই হবে।

টাইমস: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে কোনো মামলা নেই। উনি দেশে আসছেন না কেন? কবে নাগাদ আসতে পারেন?

ফখরুল: দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খুব শিগগিরই দেশে আসবেন বলে আশা করি।…

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *