‘ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে যথেষ্ট সংস্কার’ ছাড়াই তফসিল ঘোষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের উদ্যোগ ছাত্র সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।
ঢাবির শীর্ষ ছাত্র নেতারা টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেছেন, জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দাবি, ‘প্রশাসনের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে যথেষ্ট সংস্কারের’ প্রস্তাব মেনেই ডাকসু নির্বাচন করা। এর অভাবে ডাকসুতে ছাত্রদের পরিপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে না বলে এটি কাঙ্ক্ষিত ভূমিকাও রাখতে পারবে না।
তাদের মতে, নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা ‘অনির্বাচিত উপাচার্য’ থেকে সরিয়ে যে সিন্ডিকেটে দেওয়া হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব নেই বলে আগের মতোই ডাকসুর ওপর প্রশাসনিক আধিপত্য বহাল থাকবে।
আর ঢাবি প্রশাসন বলছে, যে সব সংস্কার প্রস্তাব বর্তমান প্রেক্ষাপটে জরুরি ও আইনসঙ্গতভাবে সম্ভব, তারা সেগুলো অনুমোদন করেছেন। তবে সব দাবি তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

গত মঙ্গলবার ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন।
তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসুতে হবে ভোট গ্রহণ। ঢাবির বিভিন্ন হলে বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে খসড়া ভোটার তালিকা। খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী, এবারের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৯৩২ জন। এরমধ্যে ছাত্র ভোটার ২০ হাজার ৯০৪ জন ও ছাত্রী ভোটার ১৯ হাজার ২৮ জন।
ভোটার তালিকার বিষয়ে আপত্তি জানানোর শেষ তারিখ ৮ আগস্ট। এরপর ১১ আগস্ট চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বিতরণ করা শুরু হবে ১২ আগস্ট। ১৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ১৯ আগস্ট বেলা ৩টা।
মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হবে ২০ আগস্ট। এরপর প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হবে ২১ আগস্ট দুপুর ১২টায়। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৪ আগস্ট দুপুর ১২টা। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ২৫ আগস্ট বিকেল ৪টায়। এ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত। নির্বাচনের ফলাফলও ৯ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হবে।
২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ডাকসুর নির্বাচন আয়োজনের দাবি নতুন করে জোরালো হয়ে ওঠে।
একটি ‘ন্যায়সঙ্গত ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছ থেকে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তবে ছাত্রসংগঠন গুলোর মতে, গঠনতন্ত্র সংস্কারের মূল প্রস্তাব এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘সম্প্রতি তফসিল ঘোষণার সভায় আমরা সংস্কার প্রস্তাবগুলো আবারও প্রশাসনের কাছে তুলে ধরেছি এবং আশা করেছি প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করে দেখবে।’
ইসলামী ছাত্র শিবির ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহিউদ্দিন খান ডাকসুর মতো ছাত্র-নির্বাচিত সংগঠনের ভেতরে ‘অনির্বাচিত’ ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার সমালোচনা করেন। তাদের মতে, এটি ডাকসুর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধান দাবি হচ্ছে অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দায়িত্বে এলে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধান করবেন।’
ছাত্র ফেডারেশন ঢাবি শাখা সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, ‘গঠনতন্ত্রের কিছু সংশোধনীতে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রস্তাবের কিছু অংশ মেনে নিলেও, সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এখনো উপাচার্যের হাতে কেন্দ্রীভূত। এর ফলে ডাকসুর উপরে প্রশাসনের আধিপত্য থেকে যাবে
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ছাত্র সংগঠনগুলোর কিছু প্রস্তাব খসড়া গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় উপাচার্যের একক ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কিছুটা কমেছে।’
তবে তিনি মনে করেন, প্রশাসনের প্রভাব এখনো বজায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে উপাচার্য সিন্ডিকেটের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু সেই সিন্ডিকেটে কোনো ছাত্র প্রতিনিধি নেই, ফলে ডাকসুর ওপর প্রশাসনিক আধিপত্যের সংস্কৃতি এখনো রয়ে গেছে।’
ঢাবির প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধানের ৭৩ অনুচ্ছেদে সংশোধন আনতে হবে, যেটি সংসদের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব না। ফলে, সেই দাবিগুলো বর্তমানে কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার বহির্ভূত।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব বিষয় আমাদের এখতিয়ারে পড়ে এবং বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে যথাযথ ও যুক্তিসংগত মনে হয়েছে, সেগুলো আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি।’
সংস্কারের প্রশ্নে ছাত্র সংগঠন ও প্রশাসনের এমন মুখোমুখি অবস্থানের আবহে ৯ সেপ্টেম্বর হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন।
ডাকসুর ইতিহাসে এবারই প্রথম আবাসিক হলের বাইরে মোট ৬টি কেন্দ্রে হবে নির্বাচন।
২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী থেকে বর্তমান শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থী ও ভোটার হতে পারবেন। সবশেষ, ডাকসু নির্বাচন হয় ২০১৯ সালে।