নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের মুখে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর নেতাকর্মীরা আত্মগোপন করেছেন। পাহাড়ের সূত্রগুলো বলছে, শান্তিচুক্তি বিরোধী মূলদলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন। এমনকি পরিস্থিতি আগাম আঁচ করতে পেরে শীর্ষ নেতা প্রসিত বিকাশ খীসাসহ কয়েকজন নেতা পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।
ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় সংগঠক অংগ্য মারমা পার্বত্য পরিস্থিতি সম্পর্কে টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পাহাড়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে নির্যাতন-নিপীড়ন, অঘোষিত সেনা শাসন চালিয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা আশা করেছিলাম। কিন্তু এ সরকারও হাসিনা সরকারের কায়দায় একই রকম দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে।’
ইউপিডিএফ-কে একটি ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল’ দাবি করে অংগ্য মারমা বলেন, ‘১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছে। ২০০১ সাল থেকে বেশ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সরকার আমাদের গণতান্ত্রিক দল হিসেবে মেনে নিয়েছে।’
বর্তমান নিরাপত্তা অভিযান সম্পর্কে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দল হলেও, আমাদের সঙ্গে সেভাবে আচরণ করা হচ্ছে না। আমাদের বিরুদ্ধে দমনমূলক অভিযান চালানো হচ্ছে। আমরা কতটুকু স্বাধীনভাবে সাংগঠনিক কাজ করতে পারছি? বার বার আমাদের মিছিল-মিটিং-এ হামলা করা হচ্ছে। এমনকি ২০১৮ সাল থেকে খাগড়াছড়ি সদরে স্বনির্ভর এলাকার কার্যালয়টিও আমরা খুলতে পারছি না।’
তিনি প্রশ্ন রেখে আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি ভাল নয়। এ পরিস্থিতিতে আমরাই (কেন্দ্রীয় নেতারা) বা কতটুকু প্রকাশ্যে বের হতে পারছি?’

গত ৫ জুলাই আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ‘রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ে’ ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
পাহাড়ের সূত্রগুলো বলছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম সেনাবাহিনী ইউপিডিএফ তো বটেই, এমনকি সেখানের কোনো আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে অভিযান শুরু করল।
ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সশস্ত্র তৎপরতা, গোষ্ঠীগত অন্তর্দ্বন্দ্বে হত্যা, চাঁদাবাজি, অপরহণ, গুম খুন ও রাহাজানির পুরনো অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা অভিযানে তাদের বেশ কয়েকজন ক্যাডারকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করাও হয়েছে।
গত এপ্রিলেই চাকমাদের ‘বিঝু’ উৎসবের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন পাহাড়ি শিক্ষার্থী অপহৃত হন। সে সময় জিম্মি মুক্তিপণ আদায়সহ ওই অপহরণের নেপথ্যে ইউপিডিএফ-এর নাম গণমাধ্যমে এসেছে।
তবে দলটি বরাবরই এসব ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ভোর রাতে সেনা অভিযানে বান্দরবানের রুমার দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহীগ্রুপ ‘কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি’র (কেএনএ) কমান্ডার পুতিন একজন সহযোগীসহ মারা যান। উদ্ধার হয় বেশকিছু অস্ত্র-শস্ত্র ও নথিপত্র।
এ দিন ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলমান রয়েছে। সম্প্রতি পরিচালিত অভিযানে অভিযুক্ত ২৩ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানের সময় এক সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন।
কর্নেল শফিকুল বলেন, ‘সেনাবাহিনী দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছে।’
এমন আবহে নিরাপত্তা অভিযানের মুখে ইউপিডিএফ-এর নেতাকর্মীরা সকলে আত্মগোপনে গিয়েছেন। দলের ফেসবুক পেজটিও নিস্ক্রিয় করা হয়েছে।
শীর্ষ নেতারা একে একে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে
ইউপিডিএফ-এর ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি সম্মেলনের মাধ্যমে ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আড়াই দশক ধরে প্রসিত খীসা, রবিশঙ্কর চাকমাসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা অনেকটা প্রকাশ্যেই বসবাস করতেন ঢাকায়। দলের সদর দপ্তরও ঢাকাতেই।
২০০৬ সালের নভেম্বরে ঢাকায় দলের প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে প্রসিতকে সভাপতি ও রবিকে দেওয়া হয় সাধারণ সম্পাদকের পদ। বামতাত্ত্বিক বদরুউদ্দীন উমর সমর্থিত জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সঙ্গে মতৈক্য থাকায় তাদের বিভিন্ন সভাতেও এ দু’জনকে নিয়মিত অংশ নিতে দেখা গেছে।
তবে পাহাড়ের অশান্ত পরিস্থিতিতে বছরখানেক আগে প্রসিত ও রবি দু’জনেই পাড়ি জমিয়েছেন ভারতের ত্রিপুরায়। এ সময় তাদের কোনো মাঠের কর্মসূচি তো দূরের কথা, বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেও দেখা যায়নি।
কেন্দ্রীয় নেতা অংগ্য মারমা অবশ্য এ তথ্য স্বীকার করেননি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দেশত্যাগের কথা অমূলক। বিভিন্ন মাঠের কর্মসূচিতে তাদের থাকতে হবে কেন? তাছাড়া নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় নেতারা কতটুকু নিরাপদ?’
ভিন্ন একটি সূত্র জানিয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ‘আয়নাঘরে’ বন্দিজীবন কাটিয়ে মুক্ত হন ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় সংগঠক মাইকেল চাকমা। প্রসিত-রবির অবর্তমানে দলের হাল ধরেন তিনি। ‘আয়নাঘরের’ বন্দি জীবনের অজানা অনেক কথা তুলে ধরেন গণমাধ্যমে। সবশেষ গত ১০ মে ঢাকায় দলের এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে দেখা গেছে তাকে। এরপর আত্মগোপনে গেছেন মাইকেল চাকমাও।
বছর দুয়েক আগে আরেক কেন্দ্রীয় নেত্রী সমারি চাকমা পাড়ি জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনিতে প্রবাসীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে।

ভেস্তে গেছে ইউপিডিএফ-জেএসএস ঐক্যের সম্ভাবনা
পার্বত্যাঞ্চলে এখন সক্রিয় রয়েছে পাহাড়িদের অন্তত ৫টি আঞ্চলিক দল: ইউপিডিএফ (প্রসিত), ইউপিডিএফ (সংস্কারবাদী), জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (সংস্কারবাদী) এবং নাথান বমের নেতৃত্বাধীন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)।
পার্বত্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, এরমধ্যে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি—জেএসএস ‘শান্তিচুক্তি পক্ষের’ ও ইউপিডিএফ ‘শান্তিচুক্তি বিরোধী’ বলে পরিচিত। আর কেএনএফ বান্দরবানের ৯টি উপজেলা নিয়ে ‘স্বাধীন কুকি রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার নামে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসী।
সন্তু লারমার জেএসএসের সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর গঠিত এসব গ্রুপ গত আড়াই দশকে পরষ্পর বিরোধী ‘ভাতৃঘাতি রক্তক্ষয়ী সংঘাতে’ জড়িত হয়েছে। হতাহতের সংখ্যাও অনেক।
এক বছর আগে ইউপিডিএফ (প্রসিত)-এর পক্ষ থেকে সন্তু লারমার জেএসএস-এর কাছে ঐক্যের প্রস্তাব দেওয়া হলেও আদর্শিক বিরোধে এতে সাড়া মেলেনি। সে সময় ঐক্যের সমর্থনে ইউপিডিএফ বেশকিছু কর্মসূচিও পালন করে।
সম্প্রতি জেএসএস-এর সহ-সভাপতি উষাতন তালুকদার রাঙামাটির একসভায় দেওয়া বক্তব্যে প্রশ্ন তোলেন, ‘ইউপিডিএফ-কে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করার অধিকার কে দিয়েছে?’ তিনি বলেন, ‘তারা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করুক। কিন্তু বাধা দেওয়ার অধিকার তাদের নেই।’
দৃশ্যত, সাবেক গেরিলা নেতা উষাতনের এ বক্তব্যে উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব আরো স্পষ্ট হয়।