ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক অঙ্গনও সতর্কতা, কূটনৈতিকতা ও সীমিত সম্পৃক্ততার মাধ্যমে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে। ইরান যখন ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলার মুখে রয়েছে, যার লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক নেতৃত্ব, তখন তেহরান তার মিত্রদের কাছ থেকে প্রত্যাশা মত সহযোগিতা পাচ্ছে না। বিশেষ করে রাশিয়া ও মুসলিম বিশ্ব যেভাবে প্রত্যাশা করেছিল, সেভাবে দৃঢ় ও বাস্তবসম্মত সমর্থন পাচ্ছে না ইরান। একই সঙ্গে বৈশ্বিক শক্তিগুলো নিন্দা, কৌশলগত স্বার্থ ও সংঘাত এড়ানোর ঝুঁকির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে।
রাশিয়া: কূটনৈতিক ও কৌশলগত দূরত্ব
ইরানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা, ড্রোন সরবরাহ ও সাম্প্রতিক কৌশলগত চুক্তিসহ সম্পর্ক ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হলেও, রাশিয়া বেশ সংযত আচরণ করে চলেছে। এদিকে ইসরায়েল যখন ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে, তখন মস্কো কেবল নিন্দা জানিয়ে যাচ্ছে বা তেহরানের পক্ষে কোনো সামরিক বা বাস্তব সহায়তা দেয়নি।
বাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছেন। বিষয়টি থেকে স্পষ্ট যে রাশিয়া সরাসরি জড়িয়ে না পড়ে কূটনৈতিক পথ বেছে নেওয়ার দিকেই হাঁটছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে তার সূক্ষ্ম সম্পর্ক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঝুঁকি নিতে চায় না।
আরব লিগ ও ওআইসি: চিরাচরিত অবস্থান
আরব লিগ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) তাদের চিরাচরিত অবস্থানেই রয়ে গেছে। ইসরায়েলকে নিন্দা জানানো, সংযম প্রদর্শনের আহ্বান ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছে। এর বাইরে কার্যত তেমন কিছু দৃশ্যমান নয়। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ইরান, যা অনেক সুন্নি নেতৃত্বাধীন আরব দেশের সঙ্গে মতবিরোধ ও রয়েছে। ইরান নিজেদেরকে এমন এক অবস্থায় রেখেছে, যেখানে সহানুভূতি থাকলেও সমানুভূতি পাচ্ছে না।
চীন: ইরানের পক্ষে স্পষ্ট ও দৃঢ় কণ্ঠ
ইরানের মিত্রদের মধ্যে চীন সবচেয়ে স্পষ্ট ও জোরালোভাবে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানগুলোর নিন্দা জানিয়েছে। দেশটি ইরানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কথা বললেও কৌশলগত অবস্থান মেইনটেইন করে চলেছে। আস্তানায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং আগে থেকেই আরও উত্তেজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধিতায় চীনের অবস্থান পুনর্ব্যক্তও করছেন তিনি। যদিও বেইজিং সামরিক সহায়তার কথা উল্লেখ করেনি, তবে কূটনৈতিকভাবে ইরানের বৈশ্বিক মিত্রদের মধ্যে চীনের অবস্থানই সবচেয়ে দৃঢ়। একই সঙ্গে চীন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত আছে বলেও গুরুত্বের সঙ্গে বলছেন সি এবং সংঘাতের বদলে কূটনৈতিক উদ্যোগেরও ইঙ্গিত দেন তিনি।
সৌদি আরব: কথা বেশি, কাজ কম
সৌদি আরব প্রথম আরব দেশ, যারা ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানায় ও এ হামলাকে ‘স্পষ্ট আগ্রাসন’ ও ‘জঘন্য আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। তবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে রিয়াদ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তেহরানের স্বার্থে এ সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তুরস্ক: পর্যবেক্ষণ, অপেক্ষা, ও মধ্যস্থতার প্রস্তাব
তুরস্ক সাধারণত কড়া ভাষায় কথা বললেও এবার কিছুটা নীরব। দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোগান মধ্যস্থতা করতে চান। যদিও তুরস্ক প্রায়ই নিজেকে আঞ্চলিক শক্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করে, এই ক্ষেত্রে তারা দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নিতে দ্বিধান্বিত বলেই স্পষ্ট। আঙ্কারা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে তারা পক্ষ নেওয়ার পরিবর্তে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখার কৌশলগত নীতি গ্রহণ করেছে।
জার্মানি ও জি-৭: দৃঢ়ভাবে ইসরায়েলের পক্ষে
ইতোমধ্যে জার্মানি প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়েছে। দেশটির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য ইসরায়েলকে প্রশংসাও করেছেন। কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান এবং ইউরোপীয় নেতারাও একইভাবে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেন। তারা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আত্মরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেন ও একমত হন, ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের সুযোগ দেওয়া যাবে না।
ভারত: সংকটের দড়ির ওপর হাঁটা
ঐতিহ্যগতভাবেই ইরান ও ইসরায়েল ভারতের মিত্র দেশ। দেশটি এ যুদ্ধে উভয় সংকটে পড়েছে। ইসরায়েল ভারতের একটি প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার। অন্যদিকে ইরানও একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি ও ভূরাজনৈতিক অংশীদার। উভয় দেশের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গভীর হওয়ায় ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। একই সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। তবে যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই এই ভারসাম্য বজায় রাখা দিল্লির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে।
ট্রাম্প বনাম খামেনি: বাকযুদ্ধ
সামরিক ও কূটনৈতিক কৌশলের পাশাপাশি এই সংঘাত চলছে অনলাইনেও। ট্রুথ সোশ্যালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, ‘ইরানের আকাশ সম্পূর্ণভাবে ও পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে’। একই সঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ করতে হবে। এদিকে খামেনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি এ যুদ্ধে জড়ায়, তবে তার শাস্তি হবে মারাত্মক। যারা ইরান, এর ইতিহাস ও দেশটির জনগণকে জানেন, তারা কখনো হুমকির ভাষায় এই জাতির সঙ্গে কথা বলেন না। ইরানিরা সেই জাতি নয়, যারা মাথা নত করে।’
বিভক্ত বিশ্বে ইরানের একাকিত্ব
রাশিয়া, আরব বিশ্ব ও চীনের সঙ্গে অনেক ভাল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ইরান নিজেকে তুলনামূলকভাবে একা হয়ে পড়েছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও জি-৭ এর মতো প্রধান শক্তিগুলোর সমর্থন পাচ্ছে ইসরায়েল। একই সঙ্গে কৌশলগত সহনশীলতাও অর্জন করতে পেরেছে দেশটি। এদিকে ইরানের মিত্ররা বড় কোন প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত রয়েছে। তারা শুধু নিন্দা ও আহ্বানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। যারা ইরানের অবস্থানের প্রতি সহানুভূতিশীল, তারাও উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।
ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রধান ও শক্তিশালী মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দেশটি। ট্রাম্পের আগ্রাসী ভাষা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করেছে।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে। অন্যদিকে, ইরান তার মিত্রদের কূটনৈতিক সহানুভূতি পেলেও বাস্তবে অনেকটাই একা।