৯ মাসেই ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করে নতুন রেকর্ড

টাইমস রিপোর্ট
8 Min Read
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ ও বাজেয়াপ্ত করেছে দুদক। গ্রাফিক্স: এআই/টাইমস

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত নয় মাসে শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ১৩ হাজার কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের সূত্র জানিয়েছে, ওইসব সম্পদ ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা হয়েছে দুর্নীতির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশনায়।

গত বছর ৩৬১ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ হয়েছিল, আর ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচ বছরে জব্দ করা সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩,৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত নয় মাসে সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন।

আদালত ও দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত নয় মাসে প্রায় ১২,১৩৯ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করেছে দুদক। এ সময়ের মধ্যে আদালতের আদেশে তারা প্রায় ৭৭৪ কোটি টাকা অবরুদ্ধও করেছে।

দেশের বাইরে ক্রোক করা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ আর অবরুদ্ধ করা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। তবে দেশের বাইরে সম্পদ ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা অনেকটাই কাগুজে বিষয় বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, মামলার রায়ে দুদক জয়ী হলে স্থানীয়ভাবে ক্রোক বা জব্দ করা সম্পদের মালিক হবে রাষ্ট্র। কিন্তু বিদেশে থাকা সম্পদের মালিকানা পাওয়া অনেক জটিল বিষয়।

জটিলতা সত্ত্বেও, দুদক আশাবাদী। তবে বিদেশে থাকা দুর্নীতিবাজদের সম্পদ জব্দে ‘পারস্পরিক আইনি সহায়তা আইন’প্রয়োগ করতে হবে।

দুদকের জ্যেষ্ঠ আইন উপদেষ্টা মো. আসিফ হাসান টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটি একটি পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তিটি করার চেষ্টা করছে। দুই দেশ একমত হলে সম্পদ ক্রোক করা কার্যকর হবে। যদি একমত না হয় তাহলে সম্ভব হবে না।’

দুদক আশাবাদী যে, আইন ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদেশে থাকা সম্পদও রাষ্ট্রের ঘরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। দেশীয় পর্যায়ে, তারা বিশ্বাস করে—দুর্নীতির মামলায় সফল বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জব্দকৃত সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

তবু এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুদকের অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। সেখানকার কিছু প্রাক্তন কর্মকর্তা সাবেক আমলের দ্বারা এখনো প্রভাবিত। তারা পদক্ষেপ নেয় না।’

‘দুদকের তদন্তেও দুর্নীতি আছে,’ উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন: আমরা জরুরি সংস্কার প্রস্তাব করেছি যে, দুদককে অতিদ্রুত সরকারের সহযোগিতায় বিভিন্ন তদন্ত বা গোয়েন্দা এজেন্সির সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে চাকুরী থেকে বহিষ্কার করে ফৌজদারি বিচারে সোপর্দ করতে।

এসব বাস্তবায়ন করা হলে এবং সরকার যদি অগ্রসর হয় তাহলে বাকি কাজগুলো সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ কীভাবে হবে?
সাবেক সরকারের শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী আমলা ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ কীভাবে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশকে বলেন, গত ১৫-১৬ বছরের চেয়ে দুদক অগ্রসর হতে পারছে। সে সময় সংস্থাটির আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ছিল। বর্তমানে দুদকের যে সুযোগটা তৈরি হয়েছে সেটা হলো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এসেছে তারা সকলেই ক্ষমতার বাইরে, এক্ষেত্রে বিষয়টা অনেকটাই সহজ হচ্ছে। তবে প্রভাবশালীদের একটা অংশ দেশের বাইরে রয়েছে। এখানে প্রতিকূলতার একটা বিষয় রয়েছে।

দুদক সূত্র জানোয়, শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর থেকে ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১৯১ একর জমি, ২৮টি বাড়ি, ৩৮টি ফ্ল্যাট, ১৫টি প্লট, ২৩টি গাড়ি, ২৩টি কোম্পানির আট লাখ ৮৮ হাজার ডলার, ৮৬ লাখ ২০ হাজার, তিনটি কোম্পানি ও তিনটি জাহাজ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও স্লোভাকিয়াসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশিদের ৫৮২টি ফ্ল্যাট।

এছাড়া ১,০১০টি ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে গচ্ছিত আছে ৮১৭ কোটি। অবরুদ্ধ করা হয়েছে আট হাজার ৭১৩ কোটি টাকার শেয়ার, ৬৬০ গ্রাম সোনা, এক লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ ডলার, ৫৫ হাজার ইউরো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নয়টি বিও হিসাবে থাকা ৯ কোটি টাকার স্থিতি। ব্যাংক স্থিতির পরিমাণ সাত লাখ ১৩ হাজার ডলার ও ২৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮০ ইউরো।

তালিকায় যাদের নাম
সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার পরিবার, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আমির হোসেন আমু, আনিসুল হক, দীপু মনি, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, জুনাইদ আহমেদ পলক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

এছাড়াও আছেন সাবেক এমপি, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তান, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান।

সম্পদ ক্রোক ও জব্দ হওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে শিকদার গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ এবং নাবিল গ্রুপ।

সম্পত্তি ক্রোক কে করবে?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী স্বর্ণ কান্তি দাস চৌধুরী টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘সম্পত্তি ক্রোক বলতে বোঝায় আদালতের আদেশে কোন ব্যক্তির সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া বা জব্দ করা। ওই সম্পত্তি আর সেই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, বরং আদালত নিযুক্ত একজন ট্রাস্টি বা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ট্রাস্টি বা প্রশাসকের দায়িত্ব হলো ওই সম্পত্তি পরিচালনা করা, আয় করা, এবং আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এর ব্যবহার করা।’

ক্রোক করা সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘আমাদের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট বিষয়টি দেখছে। পাশাপাশি ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা সম্পদের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এটি নিয়ে কাজ করছে। সাধারণত আদালতের ভিন্ন কোনো নির্দেশনা না থাকলে ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা সম্পদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করে দুদকের ব্যবস্থাপনা ইউনিট।’

কিভাবে সম্পত্তি ক্রোক করা হয়?
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘তদন্ত বা মামলার যেকোনো পর্যায়ে আদালত কোন ব্যক্তির সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ দিতে পারেন। দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগ পেয়ে কিংবা স্বঃপ্রণোদিত হয়ে যে কারও বিষয়ে তদন্ত করতে পারেন। আইন অনুযায়ী সেই তদন্তের সময়ই অনুসন্ধানকারীদের যদি মনে হয় ওই ব্যক্তির অবৈধ সম্পদ আছে এবং সেগুলো মামলা হতে হতে বেহাত হয়ে যেতে পারে, তাহলে তখনই অনুসন্ধানকারী ওই সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন।’

আইনজীবী স্বর্ণ কান্তি দাস চৌধুরী বলেন, ‘সম্পত্তি ক্রোক সম্পূর্ণ একটি আইনি প্রক্রিয়া এবং এটি শুধুমাত্র আদালতের আদেশেই করা যায়। সম্পত্তি ক্রোকের ফলে সম্পত্তির মালিকের কিছু অধিকার সীমাবদ্ধ হতে পারে। আদালত একটি আদেশ জারি করে যাতে সম্পত্তি ক্রোক করার কারণ উল্লেখ থাকে। আদালতের কর্মকর্তা সম্পত্তির উপর একটি নোটিশ লাগিয়ে দেন যাতে জানানো থাকে যে সেই সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। সম্পত্তির মালিক আর সেই সম্পত্তি ব্যবহার করতে পারবেন না। পরে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সম্পত্তির ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়।’

জব্দ থাকা সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে কীভাবে যাবে?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি ব্যারিস্টার ওমর ফারুক টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘যারা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদালতের নির্দেশে স্থাবর–অস্থাবর উভয় সম্পদই রাষ্ট্রের অনুকূলে যাবে। অবৈধ সম্পত্তি সরাসরি রাষ্ট্রের কাছে যাবে।’

জব্দ থাকা সম্পদ বিক্রি করে টাকা ফেরত আনা সম্ভব কী না এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন: অবশ্যই সম্ভব। জব্দ থাকা সম্পদ রাষ্ট্র নিলামে দিবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেগুলো বিক্রি করবে।

তবে বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে তা অনেক কঠিন বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *