রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ইতিবাচক অগ্রগতির সম্ভাবনা তৈরি হলেও কাঙ্ক্ষিত সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়তে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার—এমন মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গবেষণা প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত আছে। মব জাস্টিসের নামে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মব তৈরির এসব ঘটনাকে ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে অভিহিত করে ছাড় দেওয়া এবং রাজনৈতিক অসহনশীলতা রোধে নির্লিপ্ততা অন্তবর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে এমন কথা বলে সংস্থাটি।
এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যদিও ব্যাংকিং খাত সংস্কারসহ অর্থনৈতিক খাতে সরকারের কিছু উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ ও প্রভাব দৃশ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে জেন্ডার, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঐকমত্যের মাধ্যমে সংস্কারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা ও সুনির্দিষ্ট পথরেখা কীভাবে নিশ্চিত হবে তা স্পষ্ট না করায় রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।’
টিআবির প্রতিবেদনে বলা হয়, মব সৃষ্টি করে গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতেও আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। গত এক বছরেও ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার, ২৬৬ জনকে হত্যা মামলার আসামি করা, দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত ৩ জন, ২৪ জনের বেশি সাংবাদিককে পদ থেকে অপসারণ, ৮ জন সম্পাদক ও ১১ জন বার্তা প্রধানকে বরখাস্ত এবং অন্তত ১৫০ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়— বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের সুষ্পষ্ট ও সুপরিকল্পিত কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়ন ও প্রকাশ না করার ফলে অন্তবর্তী সরকারের ওপর বিভিন্ন অংশীজনের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘অ্যাডহক’ প্রবণতা এবং প্রশাসন পরিচালনায় সরকারের দৃঢ়তা ও কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি দেখা গেছে।
রাজনীতিতে নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা হলেও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি চলমান। তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও আশা করার মতো কিছু দেখা যায়নি। বরং দলীয়করণের মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিস্থাপন করে নতুন রাজনৈতিক বলয় তৈরির প্রবণতা দেখা গেছে। জনপ্রশাসনে পদোন্নতি বা পদোবঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগেও রাজনৈতিক বিবেচনার অভিযোগ উঠেছে।
দেশের অর্থনীতির বিষয়ে বলা হয়, গত এক বছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি প্রায় ২ শতাংশ কমলেও, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধস নেমেছে। গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়তি হয়েছে ২০২০৪-২০২৫ অর্থ বছরে। গত এক বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত ১৫০টি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা। অর্থনৈতিক খাতে স্বস্তি নেই। এমনকি কর্মসংস্থান না বাড়ায় দেশে দারিদ্রের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাতীয় ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়ায় কীসের ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং কীসের ভিত্তিতে গুরুত্বের তারতম্য হচ্ছে, তার মানদণ্ড পরিষ্কার না। তাই কতগুলো দল একমত হলে তাকে জাতীয় ঐকমত্য বলা হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ৩০টি দলের সঙ্গে সংলাপ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে টিআইবির প্রতিবেদনে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করলেও, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মের বিদ্যমান সংস্কৃতি ধারণ ধরে দলটি আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে টিআইবি।
এ ছাড়া কয়েকটি রাজনৈতিক দলের চাপে যে প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম. আকরাম জানান, ছাত্রজনতার ওপরে হামলা ও হামলার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে সারা দেশে একহাজার ৬০২টি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে হত্যা মামলা ৬৩৮টি। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ মামলায় তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতি হলেও পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর ক্ষেত্রে গতি খুবই ধীর।
গত এক বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলা হয়েছে, যাতে অভিযুক্ত এক হাজার ১৬৮ সদস্যের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৬১ জন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ৪২৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে, এর মধ্যে ২৭টি মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আসামির তালিকায় রয়েছেন ২০৬ জন, যাদের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
টিআইবি সতর্ক করে বলেছে, জবাবদিহিমূলক প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও কার্যত অকার্যকর, যা দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভাঙার পথে বড় বাধা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ফেলো জুলকারনাইন, ফারহানা রহমান, মোহাইমেনুল ইসলাম ও মোহাম্মদ বদিউজ্জামান।