সুরের রানী সাবিনা ইয়াসমিন

আহমেদ জামান শিমুল
4 Min Read
সাবিনা ইয়াসমিন। ইলাস্ট্রেশন: পূর্ণতা/টাইমস

দেশাত্মবোধক, চলচ্চিত্রের গান—সংগীত এ দুটি শাখায় অনবদ্য অবদান সাবিনা ইয়াসমিনের। ছয় দশক ধরে যার কণ্ঠ ছুঁয়ে গেছে কোটি হৃদয়, সেই কিংবদন্তি শিল্পী শুধুমাত্র বাংলা গানের এক অনন্য ধারা তৈরি করেননি, বরং নিজেই হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহণ করা এ শিল্পী ৭১ পেরিয়ে ৭২ বছরে পা দিয়েছেন।

পাঁচ বোনের চারজনই সংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মা মৌলুদা খাতুন নিজেও ছিলেন অসাধারণ গায়িকা, এবং তার বড় বোন ফারিদা ও ফাওজিয়া—তাদের গান শেখার সূত্র ধরেই সাবিনা ইয়াসমিনের মনে সুরের বীজ রোপিত হয়। তার সংগীতের যাত্রা শুরু হয়েছিল হারমোনিয়ামে গান তোলার ব্যর্থ চেষ্টার মধ্য দিয়ে। সে হারমোনিয়ামে তোলা প্রথম গান ছিল ‘খোকন মণি সোনা’।

সংগীত ক্যারিয়ারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৬৪ সালে বেতারের ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার মাধ্যমে। এরপর শুরু হয় চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক। তার মায়ের অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদের মাধ্যমে পান প্রথম সুযোগ। ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবির ‘মধু জোছনার দীপালি’ গানটি দিয়েই তার সেলুলয়েডের যাত্রা।

প্রথম গানটি রেকর্ডিংয়ের সময় সাবিনা ইয়াসমিন ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী গার্লসের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। রেকর্ডিংয়ের ছয় দিন পরে আলতাফ মাহমুদ জানিয়েছিলেন তার গান তারা পছন্দ করেছেন। এরপর তারা মাহমুদুন নবীর সঙ্গে যৌথভাবে কণ্ঠ দেন ‘একটি পাখি দুপুরের রোদে সঙ্গীহারা একা’।

তার পরিচিতি এ গান দুটিতে আসেনি, এসেছিলো তৃতীয় গান ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ দিয়ে। এ গানটির জনপ্রিয়তার পর তিনি একে একে কণ্ঠ দেন ‘আনোয়ারা’, ‘নয়নতারা’, ‘টাকা আনা পাই’-এর মত বিখ্যাত সিনেমার গানে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চলচ্চিত্র জগতের গানে তিনি হয়ে ওঠেন সুরকারদের প্রথম পছন্দ। সত্য সাহা, সুবল দাস, খান আতাউর রহমান, আলী হোসেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার – সময়ের শ্রেষ্ঠ সব সুরকার-গীতিকার তাকে নিয়ে কাজ করেছেন। পুরো রাত স্টুডিওতে গানে কণ্ঠ দিয়ে সকালে স্কুলে ক্লাশ করতেন তিনি।

বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠ পৌঁছে গেছে বলিউডে। হিন্দি ‘আন্নাই অবিচার’ এবং ‘শত্রু’ সিনেমায় গান গেয়ে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী হিসেবে। আর.ডি. বর্মণ, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকার মতো কিংবদন্তিদের সঙ্গে কাজ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে পড়ার দিনগুলোতেও গান ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। সেসব দিনে ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, রিকশায় চড়ে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, কিংবা খুকিদের ছাদে ইমলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা— সবই আজ এক মধুর অতীত।

অভিনেত্রী কবরী ছিলেন তার প্রিয় বন্ধু। এছাড়া ওই সময়ের শবানা, ববিতা, অঞ্জনা—সবাইয়ের সঙ্গেই ছিল মধুর সম্পর্ক। আর কিংবদন্তি নায়ক রাজ্জাকের ছিলেন একান্ত ভক্ত।

দেশের সংগীত জগতের আরেক কিংবদন্তি রুনা লায়লার সঙ্গে তার দারুণ বন্ধুত্ব। দুজন মিলে কণ্ঠ দিয়েছেন ‘তুমি বড় ভাগ্যবতী’ গানটিতে। এ দ্বৈতগানটি তাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন।

তবে শিল্পীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে তার ক্ষোভও রয়েছে— “রয়্যালটি এখন নেই। অথচ কোম্পানিগুলো আয় করছে শিল্পীদের গান দিয়ে।” শিল্পীর প্রতি ন্যায্য সম্মানী নিশ্চিত করার দাবিও বারবার উঠে এসেছে তার কণ্ঠে।

সাবিনা ইয়াসমিন মনে করেন, গান কখনোই প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। বরং অন্য শিল্পীর ভালো গান শুনে তিনি প্রেরণা পেতেন— “ইশ! আমি যদি এই গানটা গাইতে পারতাম!” এমন অনুভব থেকেই তার শিল্পীসত্তার প্রকাশ।

তার গাওয়া ১৫-১৬ হাজার গানের মধ্যে নিজের হারিয়ে যাওয়া একটি গান খুঁজে পেলে তিনি যেমন আনন্দ পান, তেমনি শ্রোতারাও নতুন করে পান নস্টালজিয়ার ছোঁয়া।

১৯৭৮ সালে ‘সুজনসখী’ ছবির গান দিয়ে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। সব মিলিয়ে ১৪টি জাতীয় পুরস্কার – যা এককভাবে সর্বোচ্চ। এছাড়া ১৯৮৪ সালে তিনি পেয়েছেন একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার।

বেশ কয়েকবার ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করেছেন। এ লড়াইয়ে কিছুটা ক্লান্ত, তবুও গানই তার প্রাণ। বাড়িতে নিয়মিত অনুশীলন, কখনো রান্নাঘরে মেয়ের আবদার পূরণ, আবার কখনো ইউটিউবে নিজের পুরনো গান খুঁজে পাওয়ার আনন্দ— এভাবেই দিন কাটছে সাবিনা ইয়াসমিনের।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *