যে নির্দেশনা ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায়

কামরুজ্জামান খান
6 Min Read
প্রতীকী ছবি। গ্রাফিক্স: এআই/টাইমস

গত বছর গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত সহিংস আক্রমণ, হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা আইনের শাসনকে দুর্বল করেছে। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নির্দেশনাটি কোনো আইন বা অধ্যাদেশ ছাড়া দেওয়া হয়েছে, যা নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘন ও অসাংবিধানিক।

তারা বলেন, ‘অতীতে যা কিছু অধ্যাদেশের মাধ্যমে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তা উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে গেছে। আগামীতে যদি যদি কেউ এটা চ্যালেঞ্জ করে তাহলে নির্দেশনাও অবৈধ হয়ে যাবে।’

২০২৪ সালের এ আন্দোলনে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শত শত শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী নিহত হন। একই সময়ে, ২০ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪৪ পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারান। পরে ১৪ অক্টোবর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ঘোষণা করে, যারা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।

এই নির্দেশনা, ৫ আগস্টের পর গণতন্ত্রের পতনের দিনগুলোতে সহিংসতা ও আক্রমণকারী ঘটনার জন্য দায়মুক্তি ঘোষণা করে, যা তদন্ত বা বিচারের বাইরে রাখা হয়েছে।

আইনের শাসনের বিপরীত

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিজ্ঞপ্তি ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ সম্পর্কিত শিরোনামে ঘোষণা করে, উক্ত গণআন্দোলন বাংলাদেশের জন্য একটি ন্যায়বিচারের পথে নতুন সূচনা। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত মোট ২৪ দিনে যেসব ব্যক্তি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।

আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, ‘অকারণে হত্যা বা আঘাত করার জন্য দায়মুক্তি দেওয়া আইনের শাসনের বিরুদ্ধে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশে নেওয়া হয়েছে, যা নিরপরাধ মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে।’

বিজ্ঞপ্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সাল হাসান টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই বিজ্ঞপ্তি সিনিয়র কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দেওয়া হয়েছে। তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন এই বিষয়ে কোনো অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে কি না।’

টাইমস অব বাংলাদেশ উভয় মন্ত্রণালয়ে অনুসন্ধান চালানোর পরও এ বিষয়ে কোনো অধ্যাদেশের তথ্য জানতে পারেনি। এমনকি, অন্তর্বর্তী সরকারে প্রায় ৬০টি অধ্যাদেশ জারি হলেও, এমন কোনো নির্দেশনা ছিল না। এই বিষয়টি ওই নির্দেশনার বৈধতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

সহিংসতা ও হত্যা

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ২০ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ৬ আগস্ট ১৫ জন, ৭ আগস্ট ১ জন এবং ৮ আগস্ট ৪ জন নিহত হন। ওই সময়ে দেশ কার্যত কোনো সরকারের অধীনে ছিল না। পুলিশ স্টেশনগুলোর ওপর আক্রমণ ও পুলিশের হত্যাকাণ্ডের কারণে পুলিশ বাহিনীও পুরো নিষ্ক্রিয় ছিল।

ওই সময় ৬ আগস্ট, লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতা সুমন খানের বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬ জন মারা যান। চুয়াডাঙ্গায় আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম ফরুক জোয়াদারের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। কিশোরগঞ্জে, আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাড়িতে আক্রমণ ও অগ্নিকাণ্ডে তার গৃহকর্মী, তার সন্তান এবং আরও এক তরুণ নিহত হন।

এ ছাড়া টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মোখাদ্দেম, মেহেরপুরে নাহারুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জে তারা সরকার, পাবনায় সচীন বিশ্বাস সাজু এবং ময়মনসিংহে যুবদল কর্মী সাবুজ আকন্দকে হত্যার ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি এবং নিহতদের পরিবারগুলো অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি। তারা মনে করে, দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে মামলার জন্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

পুলিশের মৃত্যু

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১২টি পুলিশ স্টেশনে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৩ জন ২০ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হন। বাকি এক পুলিশ সদস্য ১৪ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

পুলিশের কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত শুরু হলেও, পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় তা বন্ধ হয়ে যায়। নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের জন্য কোনো সাহায্য বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে আইজিপি বাহারুল আলম জানান, এই বিষয়টি পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং ক্ষতিপূরণের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অধীনে।

ন্যায়বিচারের আশা

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘অতীতে রাজনৈতিক নিরাপত্তা দিয়ে দেওয়া দায়মুক্তি উচ্চ আদালতে বাতিল হয়েছে। তাই যেকোনো অন্যায্য দায়মুক্তি সংবিধান অনুযায়ী অবৈধ হওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের উচিত আইন অনুসারে ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সুষ্ঠু তদন্ত পরিচালনা করা।’

শিক্ষার্থীদের ও প্রতিবাদকারীদের হত্যার বিচার

গত বছরের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনরতদের ওপর হামলা চালিয়ে শত শত আন্দোলনকারীদের হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের পর, তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে।

স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া অডিও বার্তা এবং প্রতিবেদনের মতে, এসব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা নিজেই দেন শেখ হাসিনা। পরে ৫ আগস্ট তার সরকারের পতন হলে তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে ছিলেন আন্দোলনকারী, পুলিশ সদস্য, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ নাগরিক।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, জনপ্রতিনিধি আন্দোলনের মধ্যে জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৮৩৪ জন নিহত হন। তবে, ৪৪ জন নিহত পুলিশ সদস্য এই সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না তা পরিষ্কার নয়।

শেখ হাসিনাসহ অন্যরা যারা সরকারের পতনের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য অভিযুক্ত তাদে বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিচার শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *