‘মৌলিক গানকে নষ্ট করা যাবে না’

আহমেদ জামান শিমুল
6 Min Read
ব্যান্ড তারকা নকীব খান। ছবি: সংগৃহীত
Highlights
  • ‘চট্টগ্রামে আমরা যখন ‘সোলস’ শুরু করি তখন কেউ খুব একটা চিনতো না। তাছাড়া তখনকার সমাজ অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল। ওখানে থেকে ব্যান্ড দল করা অনেক বড় ব্যাপার ছিল।’’

নকীব খান—কি-বোর্ডের বাজনায় কিংবা গানের সুরে কয়েক প্রজন্মকে মুগ্ধ রেখেছেন। এ কিংবদন্তি তার ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্ণ করলেন। টাইমস অব বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-চারিতায় তিনি অকপটে বলেছেন সুরের জগতের নানা অজানা কথা।

৫০ বছর পূর্তিতে পিছনে ফিরে তাকালে তাহলে প্রথম কোন অনুভূতিটা হয়?

এত বছর ধরে মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এত বছর ধরে পাওয়াটা এটা আমার জন্য বিশাল প্রাপ্তি। সবাই কিন্তু এটা পায় না।

সংগীতজীবনের শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।

আমার পরিবারের সবাই গানের চর্চা করতেন। আমার তিন ভাইও গান করতেন। বড় ভাই চট্টগ্রামের বিখ্যাত ব্যান্ডদল ‘জিংগা গোষ্ঠী’র সদস্য ছিলেন। তিনি ব্যাংকে চাকরির কারণে ঢাকায় চলে আসলে আর সময় দিতে পারছিলেন না। তাই ১৯৭৩ সালে ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। চট্টগ্রামে তখন ‘সুরেলা’ নামক একটি দল গঠিত যারা মৌলিক গান করতো না। ১৯৭৪ সালে দলটির নাম পরিবর্তন হয়ে ‘সোলস’ হয়। আমিও যুক্ত হই। যেহেতু তারা আগে মৌলিক গান করতো না, তাই আমার প্রথম ইচ্ছাটা হলো নতুন মৌলিক গান তৈরি করা। সে জায়গা থেকে ১৯৭৪ সালে হেনা ইসলামের কথায় তৈরি করলাম ‘একাকী যখন’। এটিই আমার প্রথম সুর করা গান। সে হিসেবে আনুষ্ঠানিক ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি।

কীভাবে সুর করলেন গানটি?

হেনা ইসলাম আসলে আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন। তিনি ভাইয়াকে অনেকগুলো গান দিয়েছিলেন সুর করার জন্য। ভাইয়ার ড্রয়ারে আমি গানগুলো পাই। পেয়ে মন হলো সুর করি। যখন করা শেষ হলো ভাইয়া বাসায় আসলে তাকে ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমাকে না জানিয়ে একটা অন্যায় করেছি।’ তারপর তাকে গানটি শোনালাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মজার কথা হচ্ছে গানটি এখনও প্রকাশিত হয়নি। এবার প্রকাশ করার ইচ্ছে রয়েছে।
রেনেঁসা কীভাবে গঠিত হলো?

আমি ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সোলসে ছিলাম। ১৯৮১ বা ’৮২ সালের দিকে আমার বাবা মারা যান। বড় ভাইয়া ঢাকায় চাকরির সুবাধে আমাদের তার কাছে নিয়ে আসেন ১৯৮৩তে। ফলে সোলসের সঙ্গে প্র্যাকটিস বা শো করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঢাকায় অনেক বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম। ১৯৮৫ সালের দিকে আমরা মনে করলাম, একসঙ্গে যেহেতু প্র্যাকটিস করছি তাহলে আমরাই একটা ব্যান্ড করি না কেনো। আমি, আমার ভাই পিলু খানসহ পাঁচজন মিলে সে বছরই ‘রেনেসাঁ গঠন করি।

আপনার যখন ব্যান্ডসংগীত চর্চা শুরু করেছিলেন, তখন তা একটা আন্দোলনের মতো ছিল। সে বন্ধুর পথ কীভাবে পার করলেন?

চট্টগ্রামে আমরা যখন ‘সোলস’ শুরু করি তখন কেউ খুব একটা চিনতো না। তাছাড়া তখনকার সমাজ অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল। ওখানে থেকে ব্যান্ড দল করা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। মুরব্বীদের অনেকেই মনে করতেন, আমরা অপসংস্কৃতি চর্চা করছি। তাছাড়া প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র তখন সহজলভ্য ছিল না। অভিভাবকদের খুব একটা সমর্থন পাওয়া যেত না। আমি মেট্রিকের আগেই ‘সোলস’-এ যুক্ত হয়েছি। আমার বাবা হেডমাস্টার ছিলেন, কিন্তু তিনি কখনো বাধা দেননি, উৎসাহ দিয়েছেন। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওনা।

আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট কোনটা ছিল?

১৯৭৬ সালে ঢাকা একটা পপ মিউজিক প্রতিযোগীতা হয়েছিল—‘এটা আমাদের টার্নিং সেখানে চট্টগ্রামের দল হিসেবে ঢাকায় এসে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘সোলস’। আমি ‘সেরা কো-বোর্ডিস্ট’ ও আমাদের দলের তাজুল ইসলাম ‘সেরা গায়ক’ পুরস্কার পান। এরপর ঢাকা মেডিকেল ও শিল্পকলা, বিটিভিতে শো করলাম। আস্তে আস্তে আমাদের নাম ছড়িয়ে পরলো সবদিকে।

ব্যান্ড সংগীত দেশে প্রতিষ্ঠা করার পর আরেকটা আন্দোলন এখনও করছেন– ‘কপিরাইট ইস্যুর সমাধান’।

যদিও দেশে কপিরাইট আইন হয়েছে, তবুও সমাধান হয়নি। যে সকল ক্রিয়েটররা একটা গান তৈরি করে তাদের ঠিকঠাক রয়্যালেটি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটা তো আমাদের অধিকার।

শিল্পীরা হয়তো একটা কনসার্ট করে কিছু পাচ্ছে। কিন্তু যারা গান লিখে, যারা সুর করে তারা কিন্তু কিছুই পায় না। আমি মনে করি এখন আরেকটা সমস্যা হয়েছে ডিজিটাল হওয়ার পরে। খুব সহজেই কপি হয়ে যাচ্ছে। এটা প্রতিরোধের জন্য দরকার সঠিক প্রযুক্তি।

এখনও শ্রোতাদের কাছে পুরানো গানের আবেদন বেশি। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

শ্রোতারা নতুন গান শুনছে না তা বলবো না। আসলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কিন্তু পছন্দ পরিবর্তন হয়। আগে শুধু বিটিভি থাকায় সবাই তা দেখতো, শুনতো। এখন অনেকগুলো চ্যানেল হয়েছে, কিন্তু কোনটাতেই ভালো কোনো গানের অনুষ্ঠান নাও, সিডি নাই, অ্যালবাম নাই, কনসার্ট নাই। মানুষের কাছে যদি না পৌঁছায় তাহলে মানুষ কিভাবে বুঝবে যে ভালো গান করছে।

কর্পোরেটেও আপনার লম্বা ক্যারিয়ার, এটা কেনো বেছে নিতে হলো?

এটা আসলে জীবিকার তাগিদে। শুধু ‘তোরে পুতুলের মতো করে’ সাজিয়ে’, ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গান দুটোর ঠিকঠাক রয়্যালিটি পেতাম তা হলে তো চাকরি করতে হতো না। কোটি কোটি টাকা আয় হতো আমার এ দুটো গান থেকেই।

বিজ্ঞাপনে কাজ করলেও আপনার চলচ্চিত্রে কাজ করা হয়নি, এর কারণ কী?

আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে অবশ্যই চলচ্চিত্রে কাজ করবো। তবে সম্প্রতি কৌশিক শংকর দাসের ‘বক্সার’ সিনেমার জন্য কাজ করলাম। এটি খুব শিগগিরই মুক্তি পাবে।

বর্তমানে ব্যান্ড সংগীতচর্চাকারীদের উদ্দেশ্যে কী বার্তা দিতে চান?

সংগীত কিন্তু শর্টকাটের বিষয় না। তারকা হওয়া সহজ, কিন্তু শিল্পী হওয়া সহজ নয়। অবশ্যই সাধনা করতে হবে। এখন ভিডিও কোটি কোটি ভিউ হচ্ছে, কিন্তু অডিওটা যদি শক্তিশালী না হয় তাহলে টিকে থাকা যাবে না। টেকনোলজিকে শুধু একটা টুল হিসেবে ব্যবহার করা করতে হবে। সব দেশের সবধরণের গান শুনতে হবে।

আমাদের ফোক গানকে অনেক ফিউশনের নামে নষ্ট করছে। কিন্তু মৌলিক গানকে নষ্ট করা যাবে না। এতে করে গানগুলোর আবেদন নষ্ট হয়ে যাবে।
আপনার আগামীর পরিকল্পনা কী?

‘রেনেসাঁ’-র ৪০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। সে উপলক্ষে নতুন গান ও একটা অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা রয়েছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *