ভাঙতে হবে ‘প্রিয়াংকার’ ৬ ভবনের বর্ধিত অংশ

টাইমস রিপোর্ট
6 Min Read
প্রিয়াংকা রানওয়ে সিটির ভবনগুলোর ফাঁক দিয়ে এভাবেই দেখা যায় উড়োজাহাজ উড্ডয়নের দৃশ্য। ছবি: টাইমস

ঢাকার উত্তরার প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ছয়টি ভবনের অনুমোদহীন অংশ এক সপ্তাহের মধ্যে ভেঙে ফেলা হবে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের কারা ক্ষতিপূরণ দেবে তার সুরাহাও হবে এই সময়ের মধ্যে।

সোমবার সকালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠক থেকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

রাজউক, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, ডেভলপার কোম্পানি ও ভবন মালিকদের প্রতিনিধিরা এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক প্রসঙ্গে প্রিয়াংকা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সজল টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনুমোদন ছাড়া ভবন ও ফ্ল্যাটের বাড়তি অংশ নির্মাণে যারা দায়ী তারা ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা দেবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে ক্ষতিপূরণের টাকা গুনতে হবে।’

‘কারণ প্রিয়াংকা গ্রুপের জমিতে যারা ভবন নির্মাণ করেছে তারা সংশ্লিষ্টদের অনুমোদন নিয়েছে। ব্যত্যয় যারা ঘটিয়েছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত ফ্ল্যাট বা ভবন মালিককে জরিমানা দেবে। যেহেতু সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই ওই সব ভবন গড়ে উঠেছে তাই ক্ষতিপূরণও তাদেরই দিতে হবে।’

কেউ অনুমোদনের বাইরে বাড়তি অংশ করে থাকলে তা ভাঙতে হবে বলেও জানান তিনি।

তবে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের আইনে কোথাও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান নেই। তাই, যারা ভবন তৈরি করেছে তাদেরই নিজ খরচে ভাঙতে হবে।

সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (এয়ার ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট-এটিএম) গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. নূর-ই-আলম বলেন, ‘যেখানে প্লট দেখিয়ে অনুমোদন নিয়েছিল সেখানে ভবন নির্মাণ করা হয়নি। এটা সার্ভে অব বাংলাদেশ এবং রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের তদন্তে আগেই উঠে এসেছে। আর তখনই অনুমোদনের বাইরের উচ্চতার বিষয়টি ধরা পড়ে।’

‘যারা এটা তৈরি করেছে তারা নিজ খরচে ভাঙবে। সিভিল এভিয়েশনের আইনে কোথাও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান নেই।’

ওই এলাকার ৮৭টি ভবন তৈরিতে উচ্চতা নীতি মানা হয়নি বলেও জানান তিনি।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ করার সময় নতুন করে আশপাশের সুউচ্চ ভবন চিহ্নিত করা হয়। তখনই প্রিয়াংকা রানওয়ে সিটির ছয়টি ভবন চিহ্নিত করে বর্ধিত অংশ ভাঙতে চিঠি দেওয়া হয়।

এর মধ্যে গত ২২ জুলাই উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৩৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এরপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিমানবন্দরের আশপাশে ‘প্রতিবন্ধকতার সীমাবদ্ধকারী’ বা ‘অবসট্যাকল লিমিটেশন সারফেস (ওএলএস)’ ভবন চিহ্নিতে নতুন করে কাজ শুরু করে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ।

সিভিল এভিয়েশনের তথ্যমতে প্রিয়াংকা সোসাইটির ১৩ নম্বর প্লটে প্রথমে ৮২ ফুট উচ্চতার ভবন নির্মাণের অনুমতি ছিল। কিন্তু সেখানে যে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তার উচ্চতা প্রায় ১০২ ফুট। অর্থাৎ ৩৩ ফুটই অবৈধ।

৩০ নম্বর প্লটে নির্মিত ভবন মায়াকাব্যের অনুমোদন ৭ তলার। কিন্তু তৈরি করা হয়েছে ৮ তলা। ৮ তলা ও ছাদের উপর অনুমোদনহীন স্থাপনাসহ অতিরিক্ত ৩৩ দশমিক ৪৩ ফুট ভাঙতে হবে।

৯ নম্বর প্লটটির অনুমোদন ৫ তলা হলেও করা হয়েছে সাড়ে ৫ তলা। ভবনের ছাদে অনুমোদনহীন স্থাপনা থাকায় ১৭ দশমিক ৭৬ ফুট উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন।

উত্তরার প্রিয়াংকা রানওয়ে সিটির একাংশ। ছবি: টাইমস
উত্তরার প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির একাংশ। ছবি: টাইমস

গত ২৮ মে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এক চিঠির মাধ্যমে জানায়, প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ছয়টি ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি। বাড়তি উচ্চতা বিমান চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে সিভিল এভিয়েশন। তাই ভবনগুলোর একাংশ ভাঙতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) চিঠি দেওয়া হয়।

বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে ঝুঁকিপূর্ণ উত্তরার ওই প্রকল্পে ভার্টিকেল-২ নামে একটি ভবনে বাস করেন বেশ কয়েকজন তারকা। যাদের মধ্যে রয়েছেন মাসুম বাসার ও মিলি বাসার দম্পত্তি, নাট্যপরিচালক হিমু আকরাম, সৌরভ রহমান, অভিনেত্রী নাবিলা ইসলাম, অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, শামীম জামান, নিলয়, শ্যামল মওলা, সামিয়া অথৈ, সাজু খাদেম, আ খ ম হাসান, নাজিয়া হক অর্ষা ও তার স্বামী মোস্তাফিজুর নূর ইমরান এবং আরফান আহমেদ।

তাদের অনেকের ফ্ল্যাটের আয়তন ১৪৯০ স্কয়ার ফুটের। যাতে নান্দনিক ইনটরিয়র করা হয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের পেছনে ব্যয় হয়েছে কোটি টাকার উপরে। ২০১৯ সালে তারা ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে ২০২৪ সালে সব টাকা পরিশোধ করে ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি করেন।

এখন ক্ষতিপূরণ নিয়ে সংশয়ে আছেন তারা।

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী সোমবার বিকেলে জানান, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এখনও কিছু জানেন না তারা। বাড়ির মূল মালিক সিদ্ধান্ত জেনে বাকিদের জানাবেন।

প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভার্টিকেল-২ ভবনের মালিক সৌরভ রহমান জানান, ‘ভবনটি কত ফুট উচ্চতায় করা যাবে, তা যাচাই করে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ চিঠি দেয় সিভিল এভিয়েশন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ভবন তৈরি করেছেন। এখন সিভিল এভিয়েশন উচ্চতা নতুন করে নির্ধারণ করায় বিপাকে পড়েছেন তারা।

সৌরভ রহমান বলেন, ‘ছাদের ওপর কিছু স্থাপনা করেছি, যা অনুমোদনহীন। সেটা ভেঙে ফেলব। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের ভুলের কারণে আটতলার পুরোটা ভেঙে ফেলতে হলে ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’

অন্য পাঁচটি ভবনেও একইভাবে উচ্চতা বেশি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে একটির অন্যতম মালিক মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘নকশাবহির্ভূত অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলা হবে। তবে মূল ভবন ভাঙলে সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া না হলে উচ্চ আদালতে যাব।’

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘ভুলটা আসলে সিভিল এভিয়েশন করেছে। তাদের দেওয়া ছাড়পত্র নিয়েই প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটি ওই ভবনগুলো করছে। রাজউকের সঙ্গে মিটিংয়ে সংস্থাটি ভুল স্বীকারও করছে। সুতরাং ক্ষতিগ্রস্তরা তো ক্ষতিপূরণ চাইবেই। আমরা চেষ্টা করছি, তাদের যেন কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।’

সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে নিতে গত ২০ জুলাই ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত করা হয়ে। আগে উড়োজাহাজ অবতরণের সময় পাইলটদের ২৩২ ফুট দূর থেকে রানওয়ে দেখতে হতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন মেনে এখন থেকে ১৩২ ফুট দূর থেকে রানওয়ে দেখতে হবে। আর এ কারণেই আশপাশের ভবনের উচ্চতা নতুন করে নির্ধারণ করতে হয়েছে তাদের।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *