বিমানবন্দর ঘেঁষে তৈরি ১০৬ ফ্ল্যাটের ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্ত সোমবার

কামরুজ্জামান খান
6 Min Read
বহুতল ভবনের কারণে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে বেড়েছে উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ঝুঁকি। ছবি: অনিক রহমান/টাইমস

শাহজালাল বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য ঝূঁকিপূর্ণ ‘উত্তরা প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির’ বহুতল ভবনে ফ্ল্যাট কিনে বিপাকে পড়েছেন অনেকে। বাউনিয়া এলাকার এই ছয়টি ভবনে মোট ফ্ল্যাট ১০৬টি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ফ্ল্যাটের মালিকদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি রয়েছেন অভিনয়শিল্পীরাও। ভার্টিকেল-২ নামে একটি ভবনে অন্তত ১৪ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী ফ্ল্যাট কিনেছেন। দিয়াবাড়ি এলাকাটি শুটিং স্পট হওয়ায় শিল্পীরা সেখানে ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী হন।

ওই ছয়টি ভবন চিহ্নিত করে বর্ধিত অংশ ভাঙতে চিঠি দেওয়া হলেও মূলত ওই এলাকার ৮৭টি ভবন ঝূকিপূর্ণ। বাকিগুলোও ভাঙতে হবে পর্যায়ক্রমে।

‘ল্যান্ডপ্যাক লিমিটেড’ নামে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান উত্তরা রানওয়ে সোসাইটিতে নির্মাণকাজ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জেরিন জানান, এক নম্বর সড়কে ঝূঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হওয়া তাদের নির্মিত একটি ভবনও রয়েছে। এ নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেবে ‘প্রিয়াংকা গ্রুপ’।

বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণকালে আশপোশে যেসব সুউচ্চ ভবন চিহ্নিত করে ভাঙার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তারমধ্যে ‘প্রিয়াংকা’র ওই ছয়টি ভবন অন্যতম।

এরমধ্যে গত ২২ জুলাই উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৩৫ জনের মৃত্যু হলে নতুন করে আলোচনায় আসে বিমানবন্দর ঘেঁষে উড়োজাহাজের নিরাপদ চলাচল। শাহজালাল বিমানবন্দরের আশপাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী (অবসট্যাকল লিমিটেশন সারফেস) ভবন চিহ্নিত করতে নতুন করে কাজ শুরু করে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ।

‘প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির’ চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সজল জানান, তার প্রতিষ্ঠান শুধু জমি বিক্রি করেছে, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বিক্রি করেনি। একাধিক ভবন নির্মাতা সংস্থা সেখানে বহুতল ভবন বানিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে। তারাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নকশা অনুমোদন করিয়েছে। নকশার বাইরে নির্মাণকাজ করলে সেটি ভাঙার পাশাপাশি তাদের ক্ষতিগ্রস্তদের জরিমানাও দিতে হবে। আর যদি সিভিল এভিয়েশন অনুমতি দিয়ে এখন ভবন ভাঙতে বলে, তাদেরও দিতে হবে জরিমানা।

তিনি আরও জানান, এ নিয়ে রাজউক, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, প্লট ও ফ্ল্যাট মালিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সোমবার হবে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের জরুরি সভা। এ সভায় কারা কারা ক্ষতিপূরণ দেবেন তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হবে।

দুঃশ্চিন্তায় অভিনয় শিল্পীরা

‘প্রিয়াংকার’ ঝুঁকিপূর্ণ ছয়টি ভবনে মোট ফ্ল্যাট ১০৬টির একটিতে বাস করছেন অভিনয়শিল্পী দম্পতি মাসুম বাসার ও মিলি বাসার। ২০১৯ সালে ফ্ল্যাট কিনে ২০২৪ সালে সব টাকা পরিশোধ করে ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি করেন মাসুম।

ভার্টিকেল-২ নামের ভবনে ভবনটি তারা ফ্ল্যাট কিনেছেন সেখানে নাট্যপরিচালক হিমু আকরাম, সৌরভ রহমান, অভিনেত্রী নাবিলা ইসলাম, অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, শামীম জামান, নিলয়, শ্যামল মওলা, সামিয়া অথৈ, সাজু খাদেম, আ খ ম হাসান, নাজিয়া হক অর্ষা ও তার স্বামী মোস্তাফিজুর নূর ইমরান এবং আরফান আহমেদের ফ্ল্যাট আছে।

এর অনেক ফ্ল্যাট এক হাজার ৪৯০ স্কয়ার ফুটের। যাতে নান্দনিক ইনটরিয়র করা হয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের পেছনে ব্যয় হয়েছে কোটি টাকার উপরে।

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘দুই প্রতিষ্ঠানের (সিভিল এভিয়েশন ও ‘প্রিয়াংকা’) ভুলের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছি।’  তিনি প্রশ্ন রেখে আরো বলেন, ‘শিল্পীদের এই অসহায়ত্বের কথা কার কাছে বলব?’

নথিপত্র দেখেই ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে জানান অভিনয়শিল্পী মাসুম বাসার। তার প্রশ্ন, ‘সিভিল এভিয়েশনের ভুলে ফ্ল্যাট ভেঙে ফেলা হলে আমাদের ক্ষতিপূরণ দেবে কে?’

ভবন নির্মাণে যত অনিয়ম

১৩ নম্বর প্লটে নির্মিত ভবনে সিভিল এভিয়েশন প্রথম চিঠিতে উচ্চতা বেধে দিয়েছিল ৮২ ফুট। কিন্তু ভবনটি নির্মান করা হয় প্রায় ১০২ ফুট উঁচু। পরে সিভিল এভিয়েশন নতুন চিঠিতে উচ্চতা ঠিক করে ৬০ ফুট। এ ভবনে প্রায় ৩৩ ফুট অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।

৩০ নম্বর প্লটে নির্মিত ভবন মায়াকাব্যের অনুমোদন ৭ তলার। কিন্তু তৈরি করা হয়েছে ৮ তলা। ৮ তলা ও ছাদের উপর অনুমোদনহীন স্থাপনাসহ অতিরিক্ত ৩৩.৪৩ ফুট ভাঙতে হবে।

৯ নম্বর প্লটটির অনুমোদন ৫ তলা হলেও করা হয়েছে সাড়ে ৫ তলা। ভবনের ছাদে অনুমোদনহীন স্থাপনা থাকায় ১৭.৭৬ ফুট উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন।

গত ২৮ মে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ রাজউকের মাধ্যমে ‘প্রিয়াংকার’ উল্লেখিত ছয়টি ভবনের বর্ধিত অংশ ভেঙে ফেলার জন্য নোটিশ দিয়েছে।

‘প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ‘ভার্টিকেল-২’ ভবনের মালিক সৌরভ রহমান জানান, কত ফুট উচ্চতায় ভবন নির্মাণ করা যাবে, তা যাচাই করে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ চিঠি দেয় সিভিল এভিয়েশন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ভবন তৈরি করেছেন। এখন সিভিল এভিয়েশন উচ্চতা পুনর্নির্ধারণ করেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন তার মতো সংশ্লিষ্ট ভবনের ফ্ল্যাটমালিকেরা।

সৌরভ রহমান স্বীকার করে বলেন, তিনি ছাদের ওপর কিছু স্থাপনা করেছেন, যা অনুমোদনহীন। তিনি সেটা ভেঙে ফেলবেন।

‘কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের ভুলের কারণে আটতলার পুরোটা ভেঙে ফেলতে হলে তাকে ক্ষতিপূরণ কে দেবে,’ জানতে চান তিনি।

অন্য পাঁচটি ভবনেও একইভাবে উচ্চতা বেশি। এর একটির মালিক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘নকশাবহির্ভূত অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলা হবে। তবে মূল ভবন ভাঙলে সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া না হলে উচ্চ আদালতে যাব।’

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলামের দাবি, ভুল আসলে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ করেছে। তাদের দেওয়া ছাড়পত্র নিয়েই ‘প্রিয়াংকা’ ওইসব ভবন নির্মাণ করছে। রাজউকের সঙ্গে বৈঠকে সংস্থাটি ভুল স্বীকারও করছে বলেও দাবি করেন তিনি।

রাজউকের এই প্রকৌশলী বলেন, ‘সুতরাং ক্ষতিগ্রস্তরা তো ক্ষতিপূরণ চাইবেই। আমরা চেষ্টা করছি, তাদের যেন কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।’

তবে, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সদস্য (এয়ার ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট) গ্রুপ ক্যাপ্টেন নূর-ই-আলম দাবি করেছেন, তাদের প্রথম চিঠির কারণে ‘প্রিয়াংকার’ ছয়টি ভবনের উচ্চতায় ‘গরমিল’ হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্যি নয়।

তিনি বলেন, ‘ওই এলাকার মোট ৮৭টি ভবন তৈরিতে “উচ্চতা নীতি” মানা হয়নি।’

এর আগে এ নিয়ে গত ২২ জুলাই রাজউকের সঙ্গে সিভিল এভিয়েশন, ‘প্রিয়াংকা’ এবং ফ্ল্যাটের মালিকদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। এতে বিমান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ভবনগুলোর অনুমোদনহীন অংশ ভেঙে ফেলার বিষয়ে আলোচনা হয়।

সিভিল এভিয়েশন বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে নিতে গত ২০ জুলাই ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত করা হয়েছে। আগে উড়োজাহাজ অবতরণের সময় বৈমানিকদের অন্তত ২৩২ ফুট দূর থেকে রানওয়ে দেখতে হতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন মেনে এখন তাদের ১৩২ ফুট দূর থেকে রানওয়ে দেখতে হবে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *