ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই মঞ্চে একসঙ্গে হাজির হলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন।
বুধবার বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কয়ারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশাল ‘সামরিক কুচকাওয়াজ’ আয়োজন করে চীন। সেখানেই অন্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে উপস্থিত হন পুতিন ও কিম। তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানান জিনপিং।
সিএনএনের প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, লাল গালিচায় পাশপাশি হেঁটে চলেছেন তিন নেতা। তাদের একসঙ্গে হাত মেলাতে ও আলাপচারিতায় মশগুল হতেও দেখা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই তিন নেতা আলাদা আলাদা সময়ে, পৃথক ঘটনায় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করলেও একই মঞ্চে তাদের একত্রে উপস্থিতি এটিই প্রথম। পুতিন ও কিম জং উনকে চীনের আয়োজনে একই সময়ে উপস্থিত করতে পারাকে একদিকে যেমন শি জিনপিংয়ের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, অন্যদিকে ঘটনাটি বিশ্ব কূটনীতিতে এক নজিরবিহীন মুহূর্ত হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, চীনের ওই বিশেষ সামরিক কুচকাওয়াজে উল্লেখযোগ্য কোনো পশ্চিমা নেতাকে দেখা যায়নি। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাম্প্রতিক বিবাদ, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক কূটনৈতিক দুরত্ব এবং ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকরের ঘটনাকে তিন নেতার একত্রিত হওয়ার পেছনে ইন্ধন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীনে অন্য নেতাদের সঙ্গে উপস্থিতি কিম জং উনের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে খুবই কম বিদেশ সফর করেছেন। গত ছয় বছরে এটি তার দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ এবং প্রথম বহুজাতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ।
তবে কিমের এই সফর নতুন মাত্রা পেয়েছে তার একমাত্র কন্যা কিম জু-এ’ এর কারণে। এ সফরেই বাবার পাশে তার প্রথম প্রকাশ্য উপস্থিতি দেখা যায়।
উদ্বোধনী বক্তব্যে শি জিনপিং বলেন, ‘চীনকে আর থামানো যাবে না।’ বিশ্বের নানা প্রান্তে চলমান যুদ্ধের মূল কারণ দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মানবতা আজ শান্তি না যুদ্ধ, সংলাপ না সংঘাত, পারস্পরিক জয়-জয় ফল না শূন্য-ফলাফলের খেলায় বেছে নেওয়ার সঙ্কটে দাঁড়িয়ে আছে।’
যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে জিনপিং বলেন, ‘কিছু দেশ নিজেদের তৈরি নিয়ম অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে মরিয়া। বিশ্বে তাদের আধিপত্যবাদী আচরণ আর মেনে নেওয়া হবে না।’
এর আগে এসসিও সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি দাবি করেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার আগ্রাসনের ফল নয়, বরং পশ্চিমা উসকানিতে ইউক্রেনের যুদ্ধে জড়ানোই মূল কারণ।’
বিশ্লেষকদের মতে, পুতিন এই সুযোগে রাশিয়ার ওপর ‘পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অকার্যকারিতা’ প্রমাণ করতে চাইছেন। পাশপাশি চীনের সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা জোরদার করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চাইছেন।
অবশ্য শি, পুতিন ও কিম আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিপাক্ষীয় বৈঠক করবেন কি না এখনো নিশ্চিত নয়। তবে এমন অভূতপূর্ব বৈঠকের আশা করছেন বিশ্ববাসী। তিন নেতা মুখোমুখি বৈঠকে বসলে প্রযুক্তি, জ্বালানি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমীকরণ বিশ্ব রাজনীতিতে চীন-মস্কো-পিয়ংইয়ং নতুন জোটের জন্ম দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।

কূটনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত চীনের সামরিক সরঞ্জামও আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সেনাদের জটিল প্রশিক্ষণের মহড়া, আধুনিক জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল, আন্ডারওয়াটার ড্রোন ও অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম নজরে এসেছে পশ্চিমা বিশ্বের।
এগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক প্রভাব মোকাবিলাইয় চীনের কৌশলগত বার্তা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।