বাংলাদেশে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এবং সাইবার অপরাধের মতো ঘটনায় তরুণদের জড়িয়ে পড়ার হার বাড়ছে বলে এক সমীক্ষার বরাতে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সম্প্রতি চালানো ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে ধর্ষণের ২৮ শতাংশ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ২৪ শতাংশ এবং যৌন হয়রানি বা উত্ত্যক্তের ঘটনায় ১৭ শতাংশ অপরাধীর বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
‘বাংলাদেশে নারী ও কন্যা নির্যাতন চিত্র-২০২৪’ শীর্ষক এই সমীক্ষা চালিয়েছে মহিলা পরিষদ।
মঙ্গলবার সকালে পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন অনুষ্ঠানে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও সাইবার অপরাধে তরুণ অপরাধীদের জড়িয়ে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সমীক্ষার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে মোট ১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে। ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েশিশু এবং ১৮ বছরের বেশি বয়সী নারী; এই দুই ভাগে বয়স ভাগ করে এতে তথ্যের সন্নিবেশ করা হয়েছে।
ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, গৃহকর্মী নির্যাতন ও সাইবার অপরাধ—এই আট অপরাধকে আলাদাভাবে সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে দেখা গেছে, ধর্ষণের ঘটনার ২৮ শতাংশ অপরাধী ১১–৩০ বছর বয়সী, সংঘবদ্ধ ধর্ষনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের ২৪ শতাংশের বয়স ১৬–২৫ বছর। এছাড়া উত্ত্যক্ত করা বা যৌন হয়রানির ১৭ শতাংশ ঘটনায় জড়িত অপরাধীর বয়সও ১৬–৩০ বছরের মধ্যে। এই একই বয়সীরা অর্ধেকের বেশি সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের নিচে মেয়েশিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। বিশেষ করে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানি, ধর্ষণের চেষ্টা এবং সাইবার অপরাধের বেশি ভুক্তভোগী।
অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা মূলত পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুক সংক্রান্ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এসব অপরাধের ৩১ শতাংশ ঘটছে বাড়িতে, ২৪ শতাংশ খোলা স্থানে। স্কুল, কলেজ, কর্মস্থল এবং গণপরিবহনও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের তালিকায় রয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘অপরাধী ও ভুক্তভোগী উভয়ই যখন অল্প বয়সী হয়, তখন এটি সমাজের জন্য অশনি সংকেত। যে যুবক একবার ধর্ষণের সঙ্গে জড়ায়, সে বারবার একই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে।’
ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অপরাধীদের যোগসূত্র ভাঙা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নারী বিদ্বেষী যে আবহ তৈরি হচ্ছে তা সমাজে সহিংসতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নারী ও শিশুরা প্রান্তিক গোষ্ঠী হয়ে পড়ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য নারীবান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং গণমাধ্যমকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া জরুরি।’
কিশোরী ও তরুণীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বেড়ে যাওয়া এবং এসব অপরাধে তরুণদের অধিক হারে জড়িয়ে পড়াকে বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকর্তা আফরুজা আরমান।
তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত ভয়াবহ প্রবণতা যে অল্প বয়সী তরুণরা ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এটি সমাজ গঠনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’
বাংলাদেশে সাধারণত ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই মামলা করা হয়। কিন্তু অন্যান্য সহিংসতার ক্ষেত্রে মামলার হার কম। কারণ প্রভাবশালী ব্যক্তি বা পরিবার প্রায়ই ‘মীমাংসা’র মাধ্যমে সমাধান করতে চায় বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
তবে ঘটনা ঘটার পর মামলা করার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। এখন ধর্ষণের পর ৬২ শতাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হচ্ছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক নানা উদ্যোগও কিছুটা বেড়েছে।
সমীক্ষায় যে সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছেন সে সম্পর্কেও বলেন আফরুজা আরমান। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতনের সব তথ্য প্রকাশ পায় না। নির্যাতনের মধ্যে পারিবারিক সহিংসতার খবরগুলো কম প্রকাশিত হয়। ভুক্তভোগী নারীর বয়স, পেশা সেভাবে উল্লেখ থাকে না। আইনগত পদক্ষেপ, মামলা নিষ্পত্তিসহ ঘটনার ফলোআপ সংবাদগুলোও গণমাধ্যমে পাওয়া যায় না।’