রাজধানীর গুলিস্তান ফুলবাড়িয়ায় ১০৬ দশমিক ২৮ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ১০ তলা বিশিষ্ট ‘বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স’ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ৩৭০টি দোকান মালিকসহ অতিরিক্ত ৫৯১ জনকে দোকান দেওয়ার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে আটকে গেছে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ।
গত সরকারের সময়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে কমপ্লেক্স নির্মাণকাজে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকরা হতাশায় পড়েছেন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেও তারা কোন সদুত্তর পাচ্ছেন না।
ডিএসসিসি ২০২৪ সালের ২৫ মে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজার মার্কেটে এই কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শুরু করে। ফুলবাড়িয়া আদর্শ মার্কেট, মহানগর মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট এবং বঙ্গবাজার মার্কেট মিলিয়ে কমপ্লেক্সটি নির্মিত হচ্ছে। প্রস্তাবিত ব্যয় ৩৬৫ কোটি টাকা, এবং নির্মাণ কাজ ২০২৮ সালে শেষ হওয়ার কথা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছে ‘অর্পি ইঞ্জিনিয়ারিং’।
অতিরিক্ত দোকান মালিক অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ
ফুলবাড়িয়া আদর্শ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম জানান, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ৩৭০ জন দোকান মালিকের মধ্যে সাবেক এমপি আফজাল হোসেন, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, জহিরুল ইসলাম, নাজমুল হুদা এবং মোজাম্মেল হক মজু মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে অতিরিক্ত ৫৯১ জনের নাম দোকান মালিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকের সংখ্যা বেশি।
এই ঘটনায় তিনি দুদকে লিখিত অভিযোগ দিলে, দুদক পরিচালক আরিফুল ইসলাম তদন্ত করছেন। দুদক তদন্তে সত্যতা পেয়ে ডিএসসিসিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, ৫৯১ জনের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া উচিত নয়। অভিযোগ নিষ্পত্তি না হলে কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ শেষ হতে জটিলতা সৃষ্টি হবে।
অভিযুক্তরা আড়ালে
সাবেক এমপি আফজাল হোসেন হত্যা মামলায় কারাবন্দি আছেন, নাজমুল হুদা বঙ্গবাজার পুড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এবং নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। পোড়ানোর অভিযোগে হওয়া মামলার আসামি জহিরুল ইসলামের মোবাইল ফোন বন্ধ। ডিএসসিসির সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বর্তমানে বিদেশে আত্মগোপনে আছেন। মোজাম্মেল হক মজু জানিয়েছেন, অভিযোগ দুদক তদন্ত করছে এবং তিনি সেখানে বক্তব্য দিয়েছেন।
দুদক পরিচালক আরিফুল ইসলাম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘অতিরিক্ত ৫১৯ জনকে দোকান মালিক তালিকাভুক্তিতে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে রয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের টাকা নেওয়া যাবে না, ডিএসসিসিকে এই বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
নির্মাণকাজে সমস্যা
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মীর আল মামুন টাইমস অব বাংলাদেশকে জানান, ‘কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ শুরু হলেও, বর্তমানে বেজমেন্টের পর একতলার ছাদের ঢালাই কাজ চলছে। এ জন্য ৪৬ কোটি টাকার টেন্ডার হয়েছিল। তবে, ডিএসসিসি জানিয়েছে নতুন করে টেন্ডার করার টাকা নেই। ‘সালামি’র ৮৬ কোটি টাকা সাবেক মেয়র অন্যত্র ব্যয় করেছেন।’
দশ তলা নকশার মধ্যে ৮ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে দোকান বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও, একতলা উঠতেই বাকি কাজ থেমে যাচ্ছে। ডিএসসিসির প্রশাসক ব্যবসায়ীদের পাত্তাই দেন না, যোগ করেন তিনি।
সমিতির কার্যকরী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাসেত জানান, ‘স্কয়ার ফিট অনুযায়ী ‘সালামি’ (দোকানের জন্য অগ্রিম বা এককালীন যে অর্থ পরিশোধ করা হয়) ঠিক না করে ২০০৪ সালে ২০ হাজার টাকা টোকেন মানি, ২০১৩ সালে এক লাখ টাকা এবং আগুনে পোড়ার পর ২০২৪ সালে আরও ৩ লাখ টাকা সালামি হিসেবে নেওয়া হয়েছে। কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ চলমান রাখতে দোকান মালিকেরা আরও দুই লাখ টাকা করে সালামি দিতে চাইলেও ডিএসসিসি নিচ্ছে না।’
বঙ্গবাজারে পরিকল্পিতভাবে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মামলা হলেও পুলিশ তদন্ত করছে না বলে ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন। তবে, শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. খালিদ মুনসুর বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা দু’একজনকে ধরেছি। মামলাটি তদন্তাধীন আছে।’
তহবিলের অর্থের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছেন, ‘বঙ্গবাজারের দোকানের জন্য ২ হাজার ৯৬১ জন দোকান মালিকের দেওয়া সালামির ১২৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৬ কোটি টাকার কাজ চলছে। বাকি টাকা সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস মেয়র থাকাকালীন অন্যত্র ব্যয় করেছেন।’
গোলাম কিবরিয়া টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘সালামির টাকা খরচ হয়েছে বলে হিসাব বিভাগ জানিয়েছে, তবে কোথায় খরচ হয়েছে তা স্পষ্টভাবে জানাতে পারছে না।’
ডিএসসিসির কর কর্মকর্তা (বাজার শাখা) আবু নাসের কচি জানিয়েছেন, ৫৯১ জনের ব্যাপারে তদন্তে দুদককে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং দুদকের চিঠির প্রেক্ষিতে সালামির টাকা নেওয়া হচ্ছে না। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আগুনে ক্ষতি ও ভবন পরিকল্পনা
২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। ডিএসসিসির তদন্ত কমিটির তথ্যমতে, এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন, আগুনে ৩০৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
নির্মাণাধীন ভবনে চারটি ব্লক, পাঁচটি সাধারণ সিঁড়ি, ছয়টি জরুরি সিঁড়ি এবং ৮০-১১০ বর্গফুটের ৩ হাজার ২১৩টি দোকান থাকবে। প্রতিটি তলায় ২৫০ বর্গফুটের ফুডকোর্ট ও আলাদা শৌচাগার থাকবে। ভবনে থাকবে আটটি লিফট—চারটি যাত্রী এবং চারটি পণ্য ওঠানামায় ব্যবহৃত হবে। সহজে যাতায়াতে বাজারের চারপাশে ৭ থেকে ১০ ফুট চওড়া রাস্তা থাকবে। এ ছাড়া, ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা এবং ১৬৯টি গাড়ি ও ১০৯টি মোটরসাইকেলের জন্য পার্কিংয়ের জায়গা থাকবে।
অসহায় ক্ষতিগ্রস্তরা
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মীর আল মামুন জানান, বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর খোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তৎকালীন সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটের মালিক সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম এবং বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির তৎকালীন সভাপতি নাজমুল হুদার নামে খোলা এই হিসাবে ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আসা এই সহায়তার অর্থ কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী এখনো হাতে পাননি, যেখানে হিজড়া সম্প্রদায়ের অনুদানের টাকাও রয়েছে।
মামুন জানান, কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ কবে শেষ হবে, এ নিয়ে আগুনে পোড়া দোকান মালিকরা অজানা আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।