৪ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন আরও জোরালো হতে শুরু করে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল এবং প্রয়োজনে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে এ ধর্মঘটের ডাক দেন তারা।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা কর্মসূচি পালন করেন। ঝুম বৃষ্টিতে এই ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হন রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও। তারা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন। পরে আন্দোলনকারীরা সন্ধ্যায় পরবর্তী তিন দিনের নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়েন।
নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনের সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাহিদ ইসলাম জানান, ৫ জুলাই চার দফা দাবির ভিত্তিতে জনসংযোগ এবং সারা দেশের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কর্মসূচির বিষয়ে সমন্বয় করা হবে। ৬ জুলাই বেলা তিনটায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হবে। ৭ জুলাই সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হবে।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতারা ফটকের বাইরে অবস্থান নেন। এতে আধা ঘণ্টা কোনো শিক্ষার্থী হল থেকে বের হতে পারেননি। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তালা খুলে দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন এবং ঢাকা- আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। বৃষ্টির মধ্যে ঢাকা- রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রেলপথ অবরোধ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরিশাল–কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসলামী বিশ্বিবদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় মূলত এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে (৫৬ শতাংশ) কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে টানা সাড়ে পাঁচ বছর কোনো কোটা ছাড়াই নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ হয়। ২০২১ সালে ওই পরিপত্রের ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল হওয়ার অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। গত ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে শুরু হতে থাকে নানা আলোচনা- সমালোচনা এবং বিক্ষোভ ও আন্দোলন।
২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল ছাড়াও আন্দোলনকারীদের অন্য দাবিগুলো হলো কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে আগের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে। অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য যৌক্তিক ও ন্যূনতম কোটা রাখা যেতে পারে। তবে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দিয়ে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে হবে। একই কোটা চাকরিতে একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শাহবাগ মোড় অবরোধ কর্মসূচিতে আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘২০১৮ সালে গণ–আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর নির্বাহী বিভাগ কোটা বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করেছিল, আজকে বিচার বিভাগ দিয়ে সেই কোটাকে আবার পুনর্বহাল করা হলো। এটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা প্রহসন। রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে এই সমন্বয়হীনতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করুক এবং শিক্ষার্থীদের দাবি বিবেচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সেগুলো পূরণ করুক।’
বৃষ্টিতে ভিজে শাহবাগ অবরোধ
৪ জুলাই বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে মিছিলটি শাহবাগে এসে থামে দুপুর ১২টার দিকে। শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে দাবির পক্ষে স্লোগান ও বক্তব্য দিতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। দুপুরে বৃষ্টির মধ্যেও অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত ছিল।
কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের স্লোগান ছিল, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘একাত্তরের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’।
অবরোধ চলাকালে পাশেই পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য অবস্থান করছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
শাহবাগ মোড় অবরোধের কারণে সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, হাইকোর্ট মোড়সহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন বহু মানুষ। কাছাকাছি গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অনেকে হেঁটেও রওনা হন। তবে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবা দেওয়া পরিবহনগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। গন্তব্যে পৌঁছাতে এই এলাকা এড়িয়ে চলে যানবাহনগুলো। এতে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়ে।
আন্দোলনকারীদের ছাত্রলীগের বাধা
কোটা বাতিল পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধা পান বলে অভিযোগ উঠেছে। আন্দোলনে যোগ দিতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য হল থেকে বের হতে ছাত্রলীগের বাধা পান। হুমকিও পান কেউ কেউ।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ খান ওরফে শৈশবসহ হলের কয়েকজন নেতা সকাল ১০টার পর হলের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালে আধা ঘণ্টার মধ্যে তালাটি খুলে দেওয়া হয়।
সূর্য সেন হল ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলসহ বেশ কয়েকটি হলে আন্দোলনকারীদের ভয় দেখানোর অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। যদিও ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো এ হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সড়ক-মহাসড়ক-রেলপথ অবরোধ
টানা চতুর্থ দিনের মতো ৪ জুলাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা ২৫ মিনিট থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এ সময় সড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজেও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যান।
দাবি আদায়ে টানা চতুর্থ দিনের মতো ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে বরিশাল নগরের রূপাতলী থেকে নথুল্লাবাদ পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমটিার এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। অপর দিকে কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব প্রান্তের দপদপিয়া জিরো পয়েন্ট থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়েন হাজার হাজার যাত্রী।
কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা থেকে ১২টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এ বিক্ষোভ ও অবরোধ করেন তারা।
দাবি আদায়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ী এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টায় শুরু হওয়া এ অবরোধে ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী দুই লেনে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে অন্তত ১০ কিলোমিটার যানজট দেখা দেয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকা অবরোধ করেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ওই অবরোধে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
দাবি আদায়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীরা দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তমঞ্চে সমবেত হন। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আবদুল জব্বার মোড়সংলগ্ন রেললাইনে ট্রেন অবরোধ করেন। দুই ঘণ্টা ট্রেন অবরোধ থাকার পর চলাচল স্বাভাবিক হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী প্রণব ঘোষ বলেন, ‘কোটা বাতিলের আন্দোলন চলছে এবং কোটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।’