৮ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচি আরও বিস্তৃত হতে শুরু করে। ৭ জুলাই সোমবার ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের এই কর্মসূচিতে রাজধানীতে ১১টি মোড়ে ও একটি স্থানে রেলপথ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। তার আগের দিন রোববার সাতটি স্থানে তাদের কর্মসূচি ছিল।
শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচির কারণে এদিন বিকেল থেকে রাজধানীর একটি বড় অংশে যোগাযোগ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তীব্র যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে ছিলেন মানুষ। দুর্ভোগের একপর্যায়ে অনেকে হেঁটে গন্তব্যে রওনা হন। তবে মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক থাকায় প্রতিটি স্টেশনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল।
রাজধানীর বাইরে থেকে অন্তত ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়। তারা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ময়মনসিংহে রেলপথ এবং সাভার, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রংপুর ও কুমিল্লায় মহাসড়ক অবরোধ করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই আন্দোলন চলে। সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, অর্ধবেলা ব্লকেড নয়, একটি সর্বাত্মক ব্লকেডের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ জন্য তারা ৯ জুলাই মঙ্গলবার সারা দেশে ও ঢাকা শহরে শিক্ষার্থী-প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় ও গণসংযোগ করবেন। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘটের কর্মসূচিও চলবে।
তিনি জানান, মঙ্গলবার (৯ জুলাই) বিকেলে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে বুধবারের কর্মসূচি জানিয়ে দেবেন।
চার দফা দাবির পরিবর্তে এক দফা দাবির কথা জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘দাবিটি হলো, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করতে হবে। এটা করার দায়িত্ব কেবল নির্বাহী বিভাগ ও সরকারের। এখন আর আদালত দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। সরকারই ঠিক করতে পারে, এই আন্দোলনের গতিপথ কী হবে।’
এর আগে দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয়ক দল গঠন করা হয়। এ প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম এই আন্দোলন যাতে দীর্ঘমেয়াদি না হয়। তাই এত দিন আমরা কোনো আনুষ্ঠানিক কমিটি ঘোষণা করিনি। কিন্তু দাবি আদায় না হলে আমরা মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সারা দেশে প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা এই দল গঠন করেছি।’
নাহিদ আরও বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কোনো শিক্ষার্থীকে কোনো রকম বাধা দেওয়া হলে বা হয়রানি করা হলে দাঁতভাঙা জবাব দেব।’
কর্মসূচি ঘোষণার সময় নাহিদের পাশে ছিলেন আন্দোলনের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আবু বাকের মজুমদার, মাহিন সরকার, রিফাত রশিদসহ অনেকে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকার পরিপত্র জারি করে। পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
মোড়ে মোড়ে অবরোধ
৮ জুলাই ছিল ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন। কেন্দ্রীয়ভাবে বিকেল চারটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শাহবাগ মোড়ে আসে।
শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। পাশাপাশি চলে প্রতিবাদী গান, কবিতা পাঠসহ নানা আয়োজন। এ সময় কেন্দ্রীয়ভাবে সারা দেশের আন্দোলন পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। শিক্ষার্থীরা বক্তব্যে বলেন, আন্দোলনের মুখে সরকারের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছু বিষয়ে ইতিবাচক সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। তবে যদি শিক্ষার্থীদের মৌলিক দাবিগুলো উপেক্ষা করা হয়, তাহলে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা মিছিলের একটি অংশ। বাকিরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দিকে এগোতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়, মিন্টো রোডের সম্মুখভাগ, বাংলামোটর মোড়, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট মোড়ে মিছিল নিয়ে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীদের আরেকটি অংশ শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে মৎস্য ভবন এলাকায় গিয়ে অবস্থান নেয়।
প্রায় একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর চানখাঁরপুল ও বঙ্গবাজার মোড় অবরোধ করেন। সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেলা ৩টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা কলেজের মূল ফটক থেকে মিছিল শুরু করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। প্রথমে তারা মিছিল নিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় পর্যন্ত যান। পরে মিছিলটি নীলক্ষেত মোড় হয়ে ইডেন কলেজের সামনে যায়। সেখানে মিছিলে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। মিছিলটি আবার ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে বিকেল চারটার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে অবস্থান নেয়। তাদের অবরোধ চলে সন্ধ্যা সোয়া সাতটা পর্যন্ত।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টসহ সচিবালয় এলাকা। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের একটি দল কিছু সময়ের জন্য কারওয়ান বাজার এলাকায় রেলপথ অবরোধ করেন।
ঢাকার বাইরে অবরোধ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকেল পৌনে চারটার দিকে নগরের ষোলশহর রেলস্টেশনে অবরোধ করেন। এতে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস আটকে যায়। অবশ্য আধা ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন।
দুপুর ১২টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ ভবনসংলগ্ন উড়ালসড়ক এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী রেলপথ অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ট্রেন আটকে রেলপথ অবরোধ করেছেন। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল জব্বার মোড়সংলগ্ন রেলপথে চলমান ট্রেন আটকে দেন তারা। সেখানে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট আটকে রাখার পর ট্রেন অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ দিনের মতো সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ দিনের মতো আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের নিচতলায় মানববন্ধন ও সমাবেশের মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক, রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ী এলাকা, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।