এ দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস যদি লিখতে হয়, তাহলে জহির রায়হানের নাম সর্বাগ্রে আসবে। তিনি শুধু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন, একই সঙ্গে ছিলেন লেখক, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী। তিনি শিল্পচর্চা করেছেন শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং জাতির ইতিহাস, রাজনীতি ও সংগ্রামের গভীর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তার প্রতিটি কাজে। জহির রায়হান ছিলেন সেই দুর্দান্ত মানুষ, যিনি কলম এবং ক্যামেরা—দুটিকেই ব্যবহার করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে।
কিংবদন্তি জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, বর্তমান ফেনী জেলায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে। ছাত্রজীবন থেকেই তার সাহিত্যিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। ১৯৫০-এর দশকে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস লেখায় মনোনিবেশ করেন। তার লেখা উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘হাজার বছর ধরে’ ও ‘বরফ গলা নদী’ আজও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত।
সাহিত্যেই থেমে থাকেননি এ প্রথিতযশা। ১৯৬০-এর দশকে তিনি চলচ্চিত্রে পা রাখেন। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘কখনো আসেনি’। এরপর তিনি ‘বাহানা’, ‘সোনার কাজল’, ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ একাধিক কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। বিশেষ করে ‘জীবন থেকে নেয়া’ তো বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র।
জহির রায়হানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছেন অসাধারণ দক্ষতায়। তার চলচ্চিত্র ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, সমাজ সচেতন এবং অসাধারণ শৈল্পিকতায় ভরপুর। তিনি ছিলেন বাস্তবতাকে ক্যামেরার চোখে তুলে ধরার অকুতোভয় কারিগর।
১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের প্রতীকী রূপ হিসেবে নির্মাণ করেন। ছবির মূল উপজীব্য ছিল এক পরিবারের একনায়কতান্ত্রিক আচরণ, যার মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের দমননীতি তুলে ধরা হয়। সেন্সর বোর্ডের আটকে দিলেও তিনি যুক্তি-তর্ক দিয়ে ছাড়পত্র আদায় করে নেন। এ ছবিটির প্রতিটি দৃশ্য, সংলাপ দর্শকদের হৃদয়ে ঝড় তোলে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান সরাসরি যুদ্ধে না নামলেও তার কলম এবং ক্যামেরা হয়ে ওঠে শক্তিশালী অস্ত্র। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে তিনি নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’, যা বিদেশি গণমাধ্যম ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এতে তুলে ধরা হয় পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, বাঙালির প্রতিরোধ এবং শরণার্থী সংকটের হৃদয়বিদারক চিত্র। এই চলচ্চিত্রটি শুধু একটি তথ্যচিত্র নয়, এটি এক জাতির আর্তনাদের দলিল, যা আজও বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে জহির রায়হান তার নিখোঁজ ভাই, শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে বের হন ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে। সেই খোঁজেই তিনি ঢাকার মিরপুরে যান, যা তখনো রাজাকার ও বিহারিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেখানেই তিনি নিখোঁজ হন এবং আর কখনো ফিরে আসেননি। তার এভাবে চলে যাওয়া শুধুই একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয়, বরং ছিল বাংলাদেশের এক সৃজনশীল চেতনার অপূরণীয় ক্ষতি।
জহির রায়হান বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গর্বিত অধ্যায়। তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা, যিনি অস্ত্র নয়, শব্দ ও দৃশ্যের মাধ্যমে যুদ্ধ করেছিলেন। তার জীবন, তার সৃষ্টি, তার অন্তর্ধান- সবই এক নাটকীয় ইতিহাসের অংশ, যা আজও আমাদের নাড়া দেয়।
আজ আমরা যখন সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণার খোঁজ করি, তখন জহির রায়হান আমাদের সামনে দাঁড়ান এক দীপ্তিমান পথপ্রদর্শক হয়ে। তিনি হারিয়ে যাননি, রয়ে গেছেন তার প্রতিটি শব্দে, ছবিতে ও চেতনায়।