ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনা হয়নি শহীদ জামালের

টাইমস রিপোর্ট
5 Min Read

ইয়াসিনের বয়স এখন দেড় বছর। মুখে কেবল কথা ফুটতেক শুরু করেছে। আধো আধো বোলে এরই মধ্যে বাবা, বাবা’ ডাকতে শিখেছে। কিন্তু অবুঝ এই শিশু জানে না, বাবা বলার আগেই সে তার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে। ফুটফুটে এই শিশুটির বাবা জামাল ভূইয়া (২৭) ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ডে ১৯ জুলাই বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। রেখে যান ৬ মাসের শিশু ও তার অসহায় মাকে।

শহীদ জামালের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর জেলার রাঙাবালি থানার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে। আড়াই বছর আগে পারিবারিক সম্মতিতে একই থানার মানসুরার সঙ্গে জামালের বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তাদের কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে শিশু ইয়াসিন। ছেলেকে ঘিরে দেখেছিলেন ছোট ছোট স্বপ্ন। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে বড় হাফেজ বানাবেন।

জামাল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার জালকুড়ি এলাকায় পরিবার সমেত বাস করতেন । সেখানেই রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার পরিবারের। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই স্বামী হারিয়ে দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন মানসুরা আক্তার।

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ ছিল। দেড় বছরের সংসারে সে কখনও আমার সাথে একটা খারাপ কথাও কয় নাই। মরণের এক ঘণ্টা আগেও ফোনে ছেলেরে দেখছে, আমার সঙ্গে হাসিখুশি হয়ে কথা বলছে। এক ঘণ্টা পর শুনি, ওনি আর দুনিয়াত নাই।’

‘ছেলেটা হওয়ার পর থেকে খালি ভিডিও কল দিতো আমারে ছেলেরে দেখানোর জন্য। আর কইতো, মানসুরা ওয় বাবা ডাকব কবে? বাবা ডাক শোনার জন্য অস্থির হইয়া ছিল। ছেলে এখন বাবা ডাকে, কিন্তু ওর বাবা নাই। সে ওর মুখে বাবা ডাকটাই শুনতে পারল না। মাঝে মধ্যে ওর কাকারে বাবা ডাকে ইয়াসিন। কথাটি বলে কান্নায় মূর্ছা যান এই মা।

ছেলেকে হাফেজ বানানোর ইচ্ছা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ’ওনার আমাগো ইয়াসিনরে নিয়া অনেক স্বপ্ন ছিল। ওনি প্রায় কইতো আমারে, ইয়াসিনরে বড় হাফেজ বানামু। ভালো জায়গায় পড়ামু। ওর জন্য টাকা জমানোর কথাও চিন্তা করছিল। কিন্তু একা একা ছেলেরে কেমনে বড় করুম আমি!’

জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ডে শহীদ জামালের একটি ছোট ফার্মের মুরগির দোকান ছিল। ঘটনার দিন দুপুরে বাড়ি থেকে খাবার খেয়ে দোকানে আসেন তিনি। বড় ভাই আলমাস ভূঁইয়া দোকানে আসতে নিষেধ করলেও নিষেধাজ্ঞা না মেনে দোকানে আসেন জামাল। দোকানে বসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ একটি গুলি এসে তার পায়ের ওপরের অংশে বিঁধে। গুলিটি ডান পা ছিদ্র করে বাম পা ভেদ করে বের হয়ে যায়।

আলমাস তার ভাই হারানোর মর্মান্তিক সময়ের বর্ননা দিয়ে বলেন, ‘ভাইটারে আইতে না করছিলাম। ওয় বলছিল, আমাগো ভাই ব্রাদাররা আন্দোলন করতাছে, কিছু হইবো না। আমি জলদি চইলা আসুম। যাওনের ঘণ্টাও পার হয় নাই, বাজার থেকে পরিচিত একজনে ফোন দিয়া কয়, আপনার ভাইয়ের পায়ে গুলি লাগছে। ভাবছি, পায়ে গুলি লাগছে, ভাইরে বাঁচাইতে পারুম। বাজারের কাছে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেছি। তারা বলছে ঢাকা মেডিকেল নিয়া যাইতে।’

‘রাস্তায় ওইদিন এতো বাজে অবস্থা, গাড়ি যাইতেই চায় না। অনেক কষ্ট কইরা ঢাকা মেডিকেল নেই। পথে আমার ভাই হটাৎ কয়, ভাই আমি মনে হয় বাঁচতাম না। আমার ইয়াসিনরে দেইখা রাইখো। এটা বলে ওয় কালিমা পড়ে রাস্তাতেই দম ফালায় দেয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর, ডাক্তার ওরে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আমরা পটুয়াখালী বড় বাইশদিয়ায় স্থানীয় কবরস্থানে নিয়া ভাইরে দাফন করি।’

তিনি আরও বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমরা সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ ও জেলা পরিষদ থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি। এই টাকা ইয়াসিন ও আমার মায়ের নামে ব্যাংকে রাখা হইছে।’

মেহেরজানা বিবির ছয় সন্তানের মাঝে ছোট ছিলেন জামাল। বছর ঘনিয়ে এলেও নিজের আদরের সন্তানকে হারিয়ে এখনও স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি এই মা। ছেলের কথা মনে করে রোজই কাঁদেন। তার বড় ছেলে আলমাস বলেন, ‘আম্মায় প্রতেকটা দিন কান্দে। কানতে কানতে অনেক অসুস্থ হয়ে গেছে।’

ছেলের কথা উঠতেই কান্নাভেজা কন্ঠে মেহেরজান বিবি বলেন, আমার ছেলেটায় দুপুরে ভাতটি খাইয়া মুরগিগুলারে আধার (খাবার) দিতে গেছিল। আন্দোলনের জন্য দোকানে বেচাবিক্রি কম ছিল। দোকান না চালাইলে খাওন তো ঘরে আসতো না। এজন্যই গেছিল। দোকানের মধ্যেই গুলি কইরা ওরা আমার কলিজার টুকরা ডারে মাইরা ফেলল।

ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যার বিচারের দাবি করে শহীদ জামালের মা মেহেরজান বিবি বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমার ছেলের মতো হাজারো মায়ের সন্তানরে পাখির মতো গুলি করে যারা মারছে, তাদের বিচার চাই আমি। ৬ মাসের দুধের বাচ্চারে যারা এতিম করছে, তাদের বিচার চাই। এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *