অধিকাংশ অর্থনৈতিক সূচকে উন্নতির ইঙ্গিত দেখা গেলেও, চালের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি রয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)–এর নতুন এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাসে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৫৫ শতাংশ, যা জুন মাসে ছিল ৮.৪৮ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭.৫৬ শতাংশ। চালের এই মূল্য বৃদ্ধি এককভাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ৫১.৫৫ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী বলে জানানো হয়েছে ‘অর্থনৈতিক হালনাগাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি: আগস্ট ২০২৫’ শীর্ষক জিইডি প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ টাইমস অব বাংলাদেশ-কে বলেন, ‘চালের দাম কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে এবং একে থামানোর কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। এর পেছনে বড় একটি কারণ হতে পারে ভুল উৎপাদন পূর্বাভাস।’
অর্থাৎ, চাল উৎপাদনের পূর্বাভাস যদি ভুল হয় এবং সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম পড়ে, তাহলে মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য। এ পরিস্থিতিতে সরকার চাল আমদানি বাড়াতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতকেও চাল আমদানিতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি, নিম্ন আয়ের মানুষদের সহায়তার জন্য ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) কর্মসূচির আওতা বাড়ানো দরকার।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনুস দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় দেশের অর্থনীতি চরম মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মুখে ছিল। তবে বর্তমানে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সরকার ১ বিলিয়ন ডলারের চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত দেখিয়েছে, যা মোট হিসেবে দাঁড়িয়েছে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার। জুলাই মাসে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ এবং প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে ২৯.৫ শতাংশ।
ব্যাংকিং ও রাজস্ব খাতে কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়টিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে অপরিশোধিত ঋণ ও দুর্বল তদারকি মোকাবিলায় আরও বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে ভাগ করা হয়েছে ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ এবং ‘রাজস্ব নীতি’ এই দুটি বিভাগে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা সফল হওয়ায় কিছু পণ্যে শুল্ক হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হয়েছে, যা বাংলাদেশের পণ্যের জন্য নতুন বাজারের সুযোগ তৈরি করেছে। এ ছাড়া, বিদেশি জ্বালানি সরবরাহকারীদের কাছে থাকা সরকারের অবশিষ্ট বকেয়ার বড় অংশ পরিশোধ করা হয়েছে, যার ফলে জ্বালানি সরবরাহ স্থিতিশীল হয়েছে।
সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও চালের বাজারে অস্থিরতা রয়ে গেছে। জুলাই মাসে প্রধান তিনটি চালের জাতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে, যা এককভাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্ধেকের বেশি অংশের জন্য দায়ী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যা, বৈরী আবহাওয়া, বিশেষ করে আউশ ও আমন মৌসুমে উৎপাদন হ্রাস, এবং সরকারি বিতরণ হ্রাস চালের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণ। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার বেসরকারি খাতে চাল আমদানি শুরু করেছে।
ডিজিটাল লেনদেন ও ই-কমার্স খাতে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে; গত এক বছরে ই-কমার্স বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। কৃষি ঋণ এবং শিল্প উৎপাদন এখন স্থিতিশীল।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘পূর্ববর্তী সরকারের আমলে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণে এসডিজি অর্জনের অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে।’
তবে বর্তমান প্রশাসনের অধীনে গণতান্ত্রিক সংস্কার ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণে অগ্রগতি নতুন গতি আনবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সাফল্যের পাশাপাশি প্রতিবেদনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জের কথাও বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- তরুণ বেকারত্ব, গ্রাম-শহরের বৈষম্য, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য, এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি।