দেশের বাসাবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁ, এমনকি চায়ের দোকানে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডারের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। রান্নার কাজে এই গ্যাসের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। বিশেষত শিল্প এলাকার শ্রমিক কলোনিতে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বার বার।
তবে দেশে প্রতিদিন কী পরিমাণ এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার হয়, তা নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পরিসংখ্যান থাকলেও এর সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময় দুর্ঘটনার আগে গ্রাহকরা কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেন না। দুর্ঘটনার পরও সংশ্লিষ্টরা এ সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানেও নেন না কার্যকর পদক্ষেপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, রিফিলিং এবং সিলিন্ডার বিক্রির ক্ষেত্রে তদারকি না থাকায় ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া রেগুলেটর বা হোসপাইপের মান খারাপ থাকলেও বাড়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী আলী আহমদ খান টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা এবং লাইসেন্স দেওয়া হলেও কার্যকর তদারকির অভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তাদের সুপারিশ থাকছে উপেক্ষিত। পাশাপাশি লাইসেন্স ছাড়াই অনেক রিফিল সেন্টার চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডারের বিক্রি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের অসচেতনতাও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।’
বিপিসি জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে ৫০টি কোম্পানির এলপিজি সরবরাহ লাইসেন্স রয়েছে। তবে, বেক্সিমকো, ওমেরা, ওরিয়ন, টোটাল, লফস, বসুন্ধরা, যমুনা, নাভানা, জেএমআই, সেনাসহ ১৮টি কোম্পানি এলপিজি বাজারজাত করে থাকে। সিলিন্ডারের বিভিন্ন আকার, যেমন ১২ কেজি, ২০ কেজি, ৩০ কেজি এবং ৪৫ কেজি রয়েছে। বেক্সিমকো ১২ কেজি, ২০ কেজি এবং ৩৫ কেজি সিলিন্ডার সরবরাহ করে। তবে অনেকসময় এসব সিলিন্ডার সঠিক নিয়মে রিফিল করা হয় না, যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, ‘সিলিন্ডারে নিম্নমানের ক্যাপ ব্যবহার করার কারণে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটছে, যা ডিলারদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব প্রাইভেট কোম্পানি এলপিজি সরবরাহ করছে, তাদের ডিলারদের তদারকি বাড়াতে হবে।’
সাভার, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জের কিছু ডিলারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়তি লাভের উদ্দেশ্যে অনেক সময় সিলিন্ডারের ভেতরে এলপিজি ছাড়াও পানি এবং বালু মেশানো হয়, এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়া, ফুডকোর্ট এবং স্ট্রিট ফুড কর্নারেও সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে, যেখানে সংযোগ পাইপের তাপে লিকেজ তৈরি হয় এবং দুর্ঘটনা ঘটে।
এলপিজি অপারেটর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, ‘দেশে অনেক অবৈধ রিফিলিং স্টেশন রয়েছে, যেখানে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে, পুলিশের কার্যকর অভিযান না থাকায় এসব স্টেশন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ১২ জুলাই আশুলিয়ার জিরাব পুকুরপাড় এলাকায় একটি গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ৪ জন দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধরা হলেন মিজানুর রহমান (৩০), তার স্ত্রী সাবিনা বেগম (২৫), প্রতিবেশী জয়নব বেগম (৩৫) এবং তার ভাগিনা আশরাফুল ইসলাম (২৫)। তাদের সবাই গার্মেন্টসে চাকরি করেন।
রাজধানীর সূত্রাপুর কাগজিটোলা এলাকায় ১১ জুলাই রাতে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে এক পরিবারের পাঁচ সদস্য দগ্ধ হন। দগ্ধরা হলেন, ভ্যানচালক রিপন (৪০), তার স্ত্রী চাঁদনী (৩৫), ছেলে তামীম (১৮), রোকন (১৪) এবং মেয়ে আয়শা (১.৫)।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের উপ প্রধান পরিদর্শক বলেন, ‘ভাল্ব ওরিনে ত্রুটি, চুলার ত্রুটি, সিলিন্ডারের রাবারে ত্রুটি এবং পাইপে লিকেজ এসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তার মতে, ‘সঠিক তদারকির অভাব এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ভূমিকা না থাকার কারণে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।’
এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এখন এক প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা, যা ডিলার ও গ্রাহকের অসচেতনার ফল। দুর্ঘটনা এড়াতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা এবং তদারকির গুরুত্ব আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।